নিজস্ব প্রতিবেদক: চার বছরের মারুফ, মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। সে বুঝতেই পারছে না- তার বাবার ছবি নিয়ে মা এতো কান্না কেন করছেন। সেদিকে তার কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। মারুফ তার আট মাস বয়সী ভাইকে নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। আর মারুফের মা ফাতেমা, চিৎকার করে কান্না করছেন আর বলছেন, ‘আমার স্বামীর কি দোষ, তাকে পুড়িয়ে কেন মারলো? আমার ছেলে-মেয়েকে কেন এতিম করলো? তিনটা শিশু সন্তান নিয়ে কীভাবে সংসার চলবে?’ এসব প্রশ্ন করে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ চলাকালে অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে নিহত বেলালের স্ত্রী ফাতেমা।
নিহত বেলাল হোসেনের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। একমাত্র মেয়ে ফারজানাকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তারেকের বয়স ১৩ বছর। অভাবের সংসার, তাই শিশু বয়সেই তারেক দোকানে কাজ করেন। দ্বিতীয় ছেলে চার বছরের মারুফ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। আর ছোট ছেলের বয়স মাত্র ৮ মাস। এখনও দুধ খাওয়া ছাড়েনি।
গত রোববার রাতে চট্টগ্রাম থেকে চাল নিয়ে খাগড়াছড়ির গুইমারা এলাকায় সরকারি খাদ্যগুদামে যাওয়ার পথে অবরোধকারীদের অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হন তিনি। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার মারা যান বেলাল হোসেন।
বার্ন ইনস্টিটিউটে বেলালকে এতদিন সেবা-শুশ্রুষা করেছেন জামাতা রাসেল এবং বেলালের ভাবি পারভীন। পারভীন জানান, নিহত বেলালের ছোট ছেলে এখনও দুধের শিশু। তাই তার স্ত্রী ফাতেমা ঢাকার বার্ন ইনস্টিটিউটে আসতে চাইলেও তাকে আনা হয়নি। বেলালের মৃত্যুর খবরে তার স্ত্রী আহাজারি করেই যাচ্ছে। বার বার কল দিচ্ছে আর জানতে চাচ্ছে- কখন বেলালের মরদেহ নেওয়া হবে।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু শয্যায় বেলাল বারবার পারভিনকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করতাম না। কোনো দলের মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম না। তারপরও কেন তারা আমার গায়ে আগুন দিলো। এখন আমার কিছু হলে আমার স্ত্রী-সন্তানদের কি হবে, তাদের ভরণ-পোষণ কে চালাব?’ মৃত্যুর আগে বেলালের এমন আশঙ্কাই যেন সত্যি হলো, বলেন পারভীন।
মৃত বেলালের ছোট ভাই আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, তাদের বাড়ি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার আদর্শগ্রাম মধ্যপাড়ায়। বেলাল ট্রাকের হেল্পার হিসেবে কাজ করতেন। গত রোববার রাতে চট্টগ্রাম থেকে ট্রাকে চাল নিয়ে খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গা থানার তাইন্দং সরকারি খাদ্যগুদামে ফিরছিলেন। পথে গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি এলাকায় পৌঁছালে রাস্তায় গাছ ফেলে ট্রাকের গতিরোধ করা হয়। এরপর ট্রাকটিতে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে বেলাল দগ্ধ হন আর ট্রাকের চালক ইসহাক মিয়া আহত হন। ওইদিনই তাদের মানিকছড়ি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। পরেরদিন বেলালকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার বিকেলে মারা যান তিনি।
বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম জানান, বেলালের শরীরে ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। মুখের বাম পাশ পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছিল, ডান পাশের কিছু অংশ পুড়েছিল। আর বুক থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত একেবারে ঝলসে গেছে। এতদিন তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।
রোববার দুপুরে নিহত ট্রাক শ্রমিক বেলাল হোসেনের প্রথম জানাজা হয় রাজধানীর তেজগাঁও ট্র্যাক স্ট্যান্ডে। সেখানে ট্রাক শ্রমিকরা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। এসময় বেলালকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে অবরোধকারীদের বিচারের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি নিহত বেলালের পরিবারকে সহযোগিতা দিতে সরকারের কাছে দাবিও জানান তারা।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available