কঙ্কা কণিষ্কা: কী ছিল ম্যাক্রোঁনের বাংলদেশ সফরের মূল লক্ষ্য? হঠাৎ করেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্টের কেন বাংলদেশ সফর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা খুব অস্বাভাবকি নয়। বিশেষ করে আজকের সামাজিক যোগাযোগ নির্ভর বাংলাদেশে। সরকার ঘনিষ্টরা বলছনে, এটা সরকারের এক বড় কূটনৈতিক অর্জন । বাঘা কূটনীতিকরা অবশ্য আরেক ধাপ এগিয়ে। তারা বলছেন ফ্রান্সের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য, বাংলাদেশের দরকার উন্নয়ন। সফরে মূলত এই দুইয়ের সম্মিলন হয়েছে। জলের গানের রাহুলের বাসার সাঙস্কৃতি চর্চায় যারা বুদ হয়ে ছিলেন তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। একজন রাষ্ট্রপতি তো সাধারণ নাগরিক নন। তিনি যতক্ষণ রাষ্ট্রপতি ততক্ষণ আম জনতার উদাহরণ। বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ থেকে নিশ্চয়ই আমরা বুঝতে পারি, সভ্য মানুষ কিভাবে অন্য মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
ম্যাক্রোঁনের সফর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ম্যাক্রোঁনের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রান্সের উপনিবেশ কমে আসছে। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে ফ্রান্স। তাই তাদের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য। তাই তাদের জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়া মূল উদ্দেশ্য হলো, এ অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার করা। আর বাংলাদেশের দরকার নতুন ব্যবসায়িক অংশীদার। এক্ষেত্রে ফ্রান্স যদি ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে নিজ থেকেই এসে বাংলাদেশে এসে ধরা দেয় সেটা খারাপ কি? ফ্রান্স বিশ্ব শক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বেও তারা। তাই কূটনীতিতে বাংলাদেশ এক নতুন খেলা দেখিয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশে আতিথেয়তার মাধ্যমে।
হুমায়ুন কবির আরও বলেন, “সমরাস্ত্র হোক আর এয়ারবাস হোক-তাদের মূল ফোকাসই ব্যবসা। আর মনে রাখতে হবে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের স্বতন্ত্র সামরিক উপস্থিতি আছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলটি তাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই ফ্রান্স চাইবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে। অনেকে ভাবছেন , ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিতে এসেছেন বলে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। আসলে এঅঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হতে চাইছে ফ্রান্স। ম্যাক্রনের সফর এবং সফর পরবর্তী বক্তব্যে বিষয়টি পরিস্কার। তিনি বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি "অসাধারণ সাফল্য" অর্জন করেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ইন্দো-প্যাসিফিকের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রভাব খাটানোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একই সময়ে ম্যাক্রন ফ্রান্সকে একটি বিকল্প হিসাবে সামনে দাঁড় করাতে চাইছে।
ফ্রান্সকে যদি এই অঞ্চলে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে হয় তবে বাংলাদেশ এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ ভারত, চীনসহ এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সাথে শেখ হাসিনার সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রায় রয়েছে। যেকোন ইস্যুতে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে সবার সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাই ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের শক্তি বাড়াতে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে পাশে চাইছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের গণমাধ্যম এজেন্সি ফ্রান্স প্রেস (এএফপি)- এও এভাবেই এই সফরকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
ফ্রান্স প্রেসিডেন্টের একটি বক্তব্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ম্যাক্রোঁন শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নতুন সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি। এখন আমরা গণতান্ত্রিক নীতি এবং আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে একটি তৃতীয় উপায় প্রস্তাব করতে চাই --যেখানে আমাদের কোন অংশীদারকে খাটো করা হবে না বা তাদেরকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে না।’ ফ্রান্সের গণমাধ্যম নতুন সাম্রাজ্যবাদ বলতে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবেই বলেছেন, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ফ্রান্সের অংশীদার তাই শেখ হাসিনাকে খাটো করা বা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়াটা ফ্রান্স বরদাশত করবে না। এটা ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক শক্ত বার্তা।
ম্যাক্রোঁন আরও বলেন প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এই দেশটি তাদের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে যেসব খাতে ফ্রান্স শক্তিশালী সেসব খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করতে চায়। ফ্রান্সের মতো বিশ্ব পরাশক্তি যখন বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার কথা জানায়, বাংলাদেশকে তাদের পাশে চায়, তখন বিশ্বের অন্যান্য রাজনীতিক বা পরাশক্তিদের কাছে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সক্ষমতা বা কূটনৈতিক বিচক্ষণতার এক শক্ত বার্তা পৌঁছায়।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেনে, ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রধানতম খেলোয়াড়দের একটি, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য । তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তাই বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তের এই সফর কূটনীতিতে বাংলাদেশ সরকারকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। কারণ ফ্রান্সের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করে।
নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও আছে। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যখন নানা ইস্যুতে ক্রমাগত চাপ তৈরি করছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস-এর বিষয়েও আগ্রহ রয়েছে ফ্রান্সের। অন্যদিকে পশ্চিমা সরকার প্রধানদের মধ্যে একমাত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টই চীন সফর করেছেন। চীন আবার বাংলাদেশের নানা প্রকল্পে শক্তভাবে জড়িত। এমন পরিস্থিতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঢাকার সফর এবং শেখ হাসিনার সরকারকে প্রকাশ্য সমর্থন, নির্বাচনের আগে ‘যুক্তরাষ্ট্রের কারণে তৈরি হওয়া অস্বস্তি’ কাটাতেও সহায়তা করলো। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট এবং বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি সই হয়। এরমধ্যে একটি হল ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট বা ঋণ চুক্তি। অপরটি হল বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম বিষয়ে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এর মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে একটি লেটার অব ইনটেন্ট চুক্তি। ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁন দ্বিপাক্ষিক সফরে গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available