সৈকত ইসলাম, জাবি প্রতিনিধি: সম্প্রতি টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো স্থান করাসহ নানা অর্জন নিয়ে ৫৩ বছর পার করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। এ অজর্নের সাথে অসঙ্গতি ও অপূর্ণতার জায়গাও কম নয়।
আজকের দিনে এসেও কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে কেবল তদন্ত কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে। এতে একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে অন্যদিকে উৎসাহিত হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৮ সালে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও আইনের দাবি প্রথম উত্থাপিত হলেও খোদ জাহাঙ্গীরনগরেই কোনো কোনো ঘটনা মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও আশার মুখ দেখে না।
প্রতিষ্ঠার পর ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৯২ সালে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন জাবি ছাত্র জসিম উদ্দিন মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরী করে গর্বের সাথে তা উদযাপন করে। এরপর যৌন হয়রানির ঘটনা এই ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক ঘটনায় পরিণত হয়। ফলে দেখা যায়, ২০০৫ সালে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমেদ সিদ্দিক, ২০০৬ সালে বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. গোলাম মোস্তফা, ২০০৮ সালে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন সভাপতি ছানোয়ার হোসেন সানি যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ২০১০ সালের মার্চে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এক ছাত্র কর্তৃক একই বিভাগের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। একই বছর অভিযোগ উঠে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি আব্দুল্লাহ হেল কাফির বিরুদ্ধে। ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসকল ঘটনায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৯৮ সালে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও আইনের দাবি প্রথম জাহাঙ্গীরনগর থেকেই উত্থাপিত হয়। এর একটি খসড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছেও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে নীতিমালা ও আইনের দাবিতে চলতে থাকে আন্দোলন। এরপর বিভিন্ন সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় একই দাবি বারবার সামনে আসতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি এই খসড়াটি নিয়ে আরো সমৃদ্ধ করে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী আইন-২০১০’ নামে আইন পরিষদে জমা দেয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১০ মার্চ তারিখে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই গঠিত হয় যৌননিপীড়ন বিরোধী সেল ‘অভিযোগ কমিটি’। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগমকে এ সেলের প্রধান করে গঠিত হয় ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি।
২০১১ সালে ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটি ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও সন্তোষজনক বিচার পাননি বলে অভিযোগ করেন অভিযোগকারীরা।
তবে ২০১৯ সলের ১৯ সেপ্টেম্বর সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সানওয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে একই বিভাগের ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। তদন্ত সাপেক্ষে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
যৌন নিপীড়নে সর্বশেষ অমীমাংসিত ঘটনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ, যার নিষ্পত্তিতে সময় বার বার পেছানো নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হতে থাকে। এক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাস্তি দিতে নানাভাবে বিলম্ব করছে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ে গঠিত কমিটির নানা টালবাহানার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠিত হলেও অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও শিক্ষক জনির ক্ষেত্রে কয়েকমাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও তার প্রয়োগ দেখা যায়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন এবং এর প্রয়োগ নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে বিচারাধীন ও চলমান ঘটনা নিয়ে বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক জেবউননেসা জানান, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে অনেকগুলো অভিযোগ এসেছে এবং সেগুলোর নিষ্পত্তিও হয়েছে। তবে বর্তমানে আলোচিত জনি স্যারের ইস্যু সম্পর্কে কোনো অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশান আমার কাছে পাঠায়নি। আর এজন্য এবিষয়ে জেছে কিছু করার নেই আমার।
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. পারভীন জলি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় জোরালো অবস্থান জারি রেখেছে। ১৯৯৮ সালের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আজও আমাদের শক্তি যোগায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে যে যৌননিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছিল, পরে তা সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রণীত হয়েছে। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। তবে আমাদের আরও অনেক প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যেমন আমরা র্যাগিং মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে পারিনি, মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প সর্বজন ও সর্বপ্রাণ বান্ধব করতে পারিনি, অনেক বিভাগের ক্লাসরুমের সংকট মেটেনি। এসকল প্রত্যাশা পূরণ হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ আরও উন্নত হবে, এ বিশ্ববিদ্যালয় নানা ক্ষেত্রে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান বলেন, সাম্প্রতিক এই ইস্যু নিয়ে আমাদের কাজ চলমান। প্রশাসনিক নানা কাজের কারণেই মূলত একটু দেরি হয়েছে। তবে এই অভিযোগের আলোকে গঠন করা স্ট্রাকচার্ড কমিটি অতি শীঘ্রই তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available