সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি: সাভারের চিহ্নিত মাদক কারবারিদের একজন ছিলেন স্বপন। সাভার মডেল থানায় তার নামে ছিল একাধিক মামলা। পুলিশের হাতে মাদকসহ বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছেন তিনি। এরপর থেকে যেন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন স্বপন। স্বপনের মাদক কারবারে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালেই তাকে হত্যা করে মরদেহ পুঁতে রাখতেন নিজ বাড়িতেই। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে স্বপনের দুই বাড়ি থেকে এক নারী ও এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সর্বশেষ ১১ জুন মঙ্গলবার দুপুরে সাভারের আনন্দপুরের সিটি ল্যান্ড এলাকার স্বপনের দুই তলা বাড়ির নিচতলা খুঁড়ে মানব দেহের হাড়গোড় উদ্ধার করে পুলিশ।
এর আগে, বিরুলিয়া ইউনিয়নের খনিজনগর এলাকায় স্বপনের অন্য এক বাড়ির আঙ্গিনা থেকে উদ্ধার হয় সীমা বেগম (৪২) নামের এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ। পুলিশকে তথ্য দিয়ে স্বপনের এক সহযোগীকে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সীমা বেগমকে খুন করার পর দেওয়া হয় মাটিচাপা। ওই ঘটনায় গ্রেফতার স্বপনের সহযোগী সাইফুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় মরদেহের সন্ধানে স্বপনের আনন্দপুর এলাকার বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। দুইদিন খোঁড়াখুঁড়ির পর মাটির ৭ ফুট নিচ থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের মাথার খুলিসহ হাড়গোড়। এ ঘটনায় স্বপনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
এর আগে ১০ জুন সোমবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া প্রথম দফার অভিযান রাতে বিভিন্ন কারণে স্থগিত করা হয় এবং ওই বাড়িতে পুলিশি পাহারা বসানো হয়। পরে মঙ্গলবার দুপুর থেকে ফের অভিযান শুরু করলে বিকেলে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন দেহাবশেষ।
উদ্ধার হওয়া মাথার খুলি ও হাড়গুলো ১৪ মাস আগে নিখোঁজ হওয়া সাভার পৌরসভার ইমান্দিপুরের সেলামত মিয়ার ছেলে তোফাজ্জল হোসেন ওরফে টোনোর হতে পারে বলে ধারণা করছে তার পরিবার। টোনোর পরিবার দাবি, নিখোঁজের দিন তোফাজ্জলের পরনে যে জামা কাপড় ছিল উদ্ধার হওয়া মাথার খুলি ও হাড়গোড়ের পাশ থেকে সেই জামা কাপড় পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ বলছে, উদ্ধার হওয়া মাথার খুলি ও হাড়গুলো টোনোর কিনা তা ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা যাবে।
বাড়িটির সামনে অবস্থানরত নিখোঁজ তোফাজ্জল হোসেন টোনোর চাচা বরকত মিয়া বলেন, গত বছরের ১৯ এপ্রিল সাভারের ইমান্দিপুর এলাকায় বাসার পাশে থেকে নিখোঁজ হয় আমার ভাতিজা গার্মেন্টকর্মী তোফাজ্জল হোসেন টোনো। তারপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও তার সন্ধান না পেয়ে ২১ এপ্রিল সাভার মডেল থানায় জিডি করি। সবশেষ ডিবি পুলিশ ও র্যাবের শরণাপন্ন হই ভাতিজার সন্ধান পেতে।
এক বছর পর আজ স্বপনের বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালানোর খবর পেয়ে আমরা এখানে ছুটে এসেছি। সকাল থেকেই বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছি। পুলিশ যে মাথার খুলি এবং হাড় উদ্ধার করেছে তার পাশে থাকা জামাকাপড় দেখে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এটা ভাতিজা তোফাজ্জলের দেহের অংশ।
নিখোঁজ তোফাজ্জলের বোন পূর্ণিমা বলেন, ওই হাড়গোড় আমার ভাইয়ের। আমার ভাই যেদিন নিখোঁজ হয় সেই দিন তার পরনে এই জামা কাপড় ছিল। আমি আমার ভাইয়ের খুনির ফাঁসি চাই।
স্বপনের বাড়ির পাশের ভাড়াটিয়া গার্মেন্টস কর্মী শাহনাজ বেগম বলেন, প্রায় এই বাড়ির ভেতরে মানুষের চিৎকার শুনতে পেতাম। মানুষের চিৎকার যেন বাইরে না আসে সেজন্য স্বপনের লোকজন বাড়ির ভেতরে বিভিন্ন শব্দ করতো। স্বপনের ভয়ে সন্ধ্যার পরে আমরা বাড়ির বাইরে বের হতাম না।
আনন্দপুর এলাকার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, আমি এই এলাকায় সবার আগে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছি। তিন বছর আগেও স্বপন আড়াই হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতো। বাসা ভাড়ার টাকা দিতে না পারায় এলাকায় সালিশ করে তাকে বের করে দেয়া হয়েছিল ওই সময়। এরপর ইয়াবা বিক্রি করে রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক বনে যায় সে। আনন্দপুরে ৫ শতাংশ জমির ওপর এই দোতলা বাড়িটি বছরখানেক আগে নির্মাণ করে সে। তবে এখানে সে থাকত না। মূলত এখানে সে মাদকের কারবার পরিচালনা করতো।
তিনি বলেন, এই বাড়ি ছাড়াও স্বপনের বিরুলিয়া ও মজিদপুরসহ অন্য স্থানে চার-পাঁচটি বাড়ি রয়েছে বলে শুনেছি। দুদিন ধরে তার বাড়িতে ডিবি পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। বিকেলে দেখলাম মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হলো।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঘটনাস্থলে এসে ব্রিফিং করেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান। এ সময় তিনি বলেন, গত ৬ জুন সকালে সীমা বেগম (৪২) নিখোঁজের ঘটনায় সাইফুল ইসলাম নামে স্বপনের এক সহযোগীকে সন্দেহজন হিসেবে আটক করে ডিবি পুলিশ। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওইদিন বিকেলেই স্বপনের বিরুলিয়ার খনিজনগর বাড়ির আঙ্গিনা থেকে সীমা বেগমের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে ডিবি ও সাভার মডেল থানা পুলিশ।
পরে সাইফুলকে আদালতে পাঠালে তিনি আদালতে সীমা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এ সময় সাইফুল স্বপনের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ডে আরও তিনজন জড়িত বলেন স্বীকার করেন। তারা হলেন তাইরান, আসিফ ও রেজাউল।
এসপি বলেন, এদিকে এক বছরের অধিক সময় আগে নিখোঁজ তোফাজ্জল হোসেন টোনোর সাথে স্বপনের মাদক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় ডিবি পুলিশ। পরে গ্রেফতার হওয়া স্বপনের সহযোগী সাইফুল ইসলামকে ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে টোনোকে স্বপন হত্যা করে তার বাড়িতে লাশ গুম করে রেখেছে সেকথা কথা স্বীকার করেন। পরে একদিকে স্বপনের আনন্দপুরের বাড়িতে লাশের সন্ধানে ঘোরাঘুরি শুরু করে ডিবির একটি টিম, অন্যদিকে ডিবির ওপর টিম নামে স্বপনকে গ্রেফতার অভিযানে।
অবশেষে ১১ জুন মঙ্গলবার সকালে ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়ন থেকে মাদক ও অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় স্বপন। পরে তার দেখিয়ে দেওয়া স্থান থেকেই উদ্ধার করা হয় দেহাবশেষ।
উদ্ধার করা হাড়গোড়ের সাথের জামা কাপড় দেখে প্রাথমিকভাবে তোফাজ্জল হোসেন টোনোর পরিবার দাবি করছে যে এটি টোনোর ছিল। তবে ডিএনএ পরীক্ষার পর বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে।
গ্রেফতার হওয়া স্বপন আরও কোন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা রিমান্ডে এনে তাকে জিজ্ঞাসা করলে বেরিয়ে আসবে বলেও জানান ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available