কুমিল্লা প্রতিনিধি: আমার থেকে রোহিঙ্গারাও ভালো আছে। আমার থাকার জায়গা নেই, পেটে ভাত নেই, অসুস্থ্য বলে আমার স্বামীরে কেউ কাজে নিতে চায় না। বাধ্য হয়ে আমরা ভিক্ষা করি। মানুষের কাছে চেয়ে যা পাই তাতেই চলে সংসার। আমার নিজের জদি একটা ঘড় থাকতো তাহলে তো এভাবে কষ্ট করতে হতো না। কথাগুলো বলে ফুফিয়ে কাঁদছিলেন নিলুফার আক্তার। দেখে একেবারে জসিমউদ্দিনের আসমানি মনে হবে যে কারও। কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের পশ্চিম পোমকাড়া গ্রামে নিলুফা আক্তার ও তার স্বামী মামুন মিয়া বাস করছেন একটি অস্থায়ী পরিত্যাক্ত বাড়িতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের পোমকাড়া গ্রামের তাজু মুহুরীর পরিত্যাক্ত নির্জণ বাড়িতে নিলুফার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঝোপঝারের ভেতরে প্রায় ৩০ বছর আগের একটি দোচালা টিনসেট ও একচালা একটি রান্না ঘর রয়েছে। প্রায় ৩ মাস পূর্বে ভিক্ষা করতে এসে এ বাড়িটির সন্ধান পান তারা। আশ-পাশে নেই কোনও বাড়িঘর, নির্জন ভুতুরে পরিবেশে জঙ্গল, পোকা-মাকড়, মশা, জোকের উপদ্রপে বসবাসের অনুপোযোগী এমন অস্বাস্থকর পরিবেশেই ৬ শিশু সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন তারা। নেই বিদ্যুৎসহ অন্যান্য আনুসঙ্গীক ব্যবস্থা। বাড়ির মালিকের সন্ধ্যা পাওয়া না পেলেও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এখানেই তারা অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । দোচালা টিনের ঘরটিতে নেই কোন দরজা জানালা, ঘরের বেড়া ভাঙ্গা। রান্না ঘরের চালা থাকলেও নেই কোন বেড়া। রাতের অন্ধকারে কুপি বাতিই তাদের একমাত্র ভরসা। মশা এবং জোকের উপদ্রপ থেকে বাচতে নেই মশারিও।
কথা হয় নিলুফারের স্বামী মামুন মিয়ার সাথে। সে জানায়, তার আদী বাড়ি দেবীদ্বার পৌর এলাকার বারেরা গ্রামের আজি উল্যার বাড়ি। তার পিতা মালেক মিয়া ভূমিহীন ছিলেন। তিনি উপজেলার ধামতী গ্রামের নিলুফাকে বিয়ে করেন। নিলুফা গার্মেন্টেসে চাকরি করতেন। সে সুবাদে সেও গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে স্ত্রীর সাথে চাকুরি শুরু করেন। লেখাপড়া কম জানায় ভালো বেতন না পেয়ে বাধ্য হয়ে দেবীদ্বারে চলে আসেন। পৌর এলাকার বানিয়াপাড়ার ভাড়া বাসায় থেকে ভ্যান-রিক্সা চালিয়ে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একসময় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে ভাড়া বাসায় থাকা আর সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে বারেরারচর গুচ্ছগ্রামে সুফিয়া বেগম নামে একজনের বরাদ্ধকৃত ঘরে থাকা শুরু করেন। সেখানে ছিলেন প্রায় ১০ বছড়। সুফিয়া এসময় চট্রগ্রামে থাকতেন, তিনি ফিরে এলে মামুন নিলুফা আবারও ঘরহীন হয়ে পড়েন।
ভিক্ষাবৃত্তির সুবাদে তারা পোমকাড়া গ্রামের এ পরিত্যাক্ত বাড়িটির সন্ধান পান। নিজের জাতীয় পরিচয় পত্র থাকলেও সেটি হারিয়ে ফেলেচেন মামুন। তার স্ত্রীর জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকায় মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত আছে এ পরিবারটি। এমনকি ৩ পুত্র ও ৩ কণ্যা শিশুর জন্মনিবন্ধনও করাতে পারেননি। বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভূমিহীন যাযাবর জীবন যাপনের কারনে সন্তানদেরও নেই কোন শিক্ষার সুযোগ।
স্থানীয় দুলাল মিয়া বলেন, প্রায় ৩ মাসপূর্বে এ পরিত্যাক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেন মামুনের পরিবার, তখন তার স্ত্রী গর্ভবতী ছিলো। এ বাড়ির মালিকের ১১ ছেলে সবাই প্রতিষ্ঠিত ও শিক্ষিত, তারা কেউই এলাকায় থাকেন না। বাড়িটি দখলে রাখতে প্রায় ৩০ বছর পূর্বে ১টি টিনসেট ঘর ও একটি পাকা ভবন নির্মানাধীন অবস্থায় রেখে যায় পরিবারের সদস্যরা। আমরা ছোট বেলায় দিনে-দুপুরেও এ এলাকায় আসতে ভয় পেতাম। এখনো বাড়িটেতে রয়েছে ঝোপ-ঝার এবং সাপ, বিচ্ছু, জোঁকের বসবাস। এমন পরিবেশেই পোকামাকড় ও মশা-মাছির মধ্যে এ পরিবারটি প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে বসবাস করছে। মামুনের স্ত্রীর ডেলিভারির সময় আমি সাধ্যানুযায়ী সহায়তা করেছি।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. গোলাম সারওয়ার মুকুল ভুঁইয়া বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না, এখন আপনাদের মধ্যমে শুনলাম। ইউএনওর সাথে আলোচনা হয়েছে তিনি ঘটনা সম্পর্কে জানতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন। আশা করি তারা আবাসনসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পাবে।
দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available