মিনার সুলতান: গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক হয়রানি নিয়ে বিশ্বের শতাধিক নোবেল বিজয়ী ও অন্যান্য বিশ্বনেতাদের পাঠানো খোলা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়। এই বিবৃতির বিরুদ্ধে পাল্টা বক্তব্য প্রদান করে গত ১০ সেপ্টেম্বর দেশের সকল গণমাধ্যমে একটি চিঠি পাঠায় গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ। ওই চিঠিতে গ্রামীণ টেলিকম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে।
১৪ পৃষ্ঠার এই চিঠিতে গ্রামীণ টেলিকম নিজেদের নির্দোষ দাবির অনেক চেষ্টা চালালেও, তাদের বক্তব্যেই উঠে আসে দ্বিচারিতা ও অপরাধের নানা প্রমাণ। শুধু তা-ই নয়; সুপ্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি নিজেদের অপরাধ ঢাকতে যে ধরনের যুক্তি তুলে ধরেছে চিঠিতে, গ্রামীণ টেলিকমের নিজস্ব নথিপত্রের সাথেই সেগুলো সাংঘর্ষিক। চিঠির পরতে পরতে তারা একদিকে যেমন তাদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে, তেমনি অপরাধ ঢাকতে আবার মিথ্যা তথ্যের আশ্রয়ও নিয়েছে।
চিঠির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী দারিদ্রতা দূরীকরণ ও শিক্ষিত যুবকদের বেকার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এক নতুন অর্থনৈতিক চিন্তা ধারার রূপরেখা তুলে ধরেন, যার নাম হচ্ছে সামাজিক ব্যাবসা।’ তথ্যটি সম্পূর্ণ বিকৃত। কিন্তু ম্যাকমিলান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত জে ব্যাংকসের বিখ্যাত গ্রন্থ The Sociology of Social Movement থেকে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী Social Business বা Social Entrepreneur তত্ত্বটি তুলে ধরা হয় ১৯৭২ সালে এবং বিল ড্রেইটন নামের মার্কিন ব্যবসায় এই নতুন অর্থনৈতিক চিন্তার রূপরেখা তুলে ধরেন।
মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে। চিঠির দ্বিতীয় ও তৃতীয় পৃষ্ঠায় মামলা নম্বর ২২৮/২০২১ এর বিবরণে গ্রামীণ টেলিকম জানিয়েছে, তারা ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২৮ নম্বর ধারায় সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে তারা বলছে ‘নট ফর প্রফিট কোম্পানি’। বস্তুত এই আইনের দোহাই দিয়েই তারা বক্তব্যে উল্লেখ করেছে, ‘কোম্পানি আইন অনুযায়ী যার (গ্রামীণ টেলিকম) লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়।’ কিন্তু কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা তলিয়ে দেখলেই তাদের মিথ্যাচারটি ধরা পড়ে।
কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর ২৮ ধারার প্রথম উপধারাতেই আছে, “যদি সরকারের নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত হয় যে, সীমিতদায় কোম্পানী হিসাবে গঠিত হওয়ারযোগ্য কোন সমিতি বাণিজ্য, কলা, বিজ্ঞান, ধর্ম, দাতব্য বা অন্য কোন উপযোগিতামূলক উদ্দেশ্যের উন্নয়নকল্পে গঠিত হইয়াছে অথবা গঠিত হইতে যাইতেছে এবং যদি উক্ত সমিতি উহার সম্পূর্ণ মুনাফা বা অন্যবিধ আয় উক্ত উদ্দেশ্যের উন্নতিকল্পে প্রয়োগ করে বা প্রয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং উহার সদস্যগণকে কোন লভ্যাংশ প্রদান নিষিদ্ধ করে, তবে সরকার উহার একজন সচিবের অনুমোদনক্রমে প্রদত্ত লাইসেন্সের মাধ্যমে এই মর্মে নির্দেশ দিতে পারিবে যে, উক্ত সমিতির নামের শেষে ‘সীমিতদায়’ বা ‘লিমিটেড’ শব্দটি যোগ না করিয়াই উহাকে একটি সীমিতদায় কোম্পানী হিসাবে নিবন্ধিকৃত করা হউক, এবং অতঃপর উক্ত সমিতিকে তদনুযায়ী নিবন্ধিকৃত করা যাইতে পারে।”
দুটি তথ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এক: কোম্পানির মুনাফা কোম্পানি যে উদ্দেশে গঠিত হয়েছে (গ্রামীণ টেলিকমের ক্ষেত্রে সামাজিক উন্নয়ন), তার উন্নতিতে ব্যয় হবে। দুই: কোম্পানির সদস্যগণ কোনো লভ্যাংশ নিতে পারবেন না।
চিঠিতে বলা হয়েছে, কোম্পানি আইন অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকমের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ তাদের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণযোগ্য নয়। এই কথা আইনানুযায়ী সঠিক হবে, যদি ও কেবল যদি এই টাকা তারা সামাজিক উন্নয়ন বা দাতব্যে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সেটা কী তারা করছে? গ্রামীণ টেলিকমের আর্থিক প্রবাহটি দেখলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানের মূলধন তহবিলের পরিমাণ ৫৩.২৬ কোটি টাকা, যা সরবরাহ করেছে গ্রামীণ কল্যাণ তহবিল। অর্থাৎ দাতব্য প্রতিষ্ঠানরূপে গ্রামীণ ব্যাংক যে গ্রামীণ কল্যাণ তহবিল গঠন করেছিল, তার অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডে। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠান গড়েই উঠেছে আরেকটি সেবা তহবিলের টাকায়, যা আইন অনুযায়ী অবৈধ।
কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকম তার লভ্যাংশ কোথাও বিনিয়োগ করতে পারবে না (কেবল সামাজিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে)। কিন্তু রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোন লিমিটেডসহ মোট ১২টি প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করেছে, যার প্রতিটিই ব্যবসায়িক। তার ধারণকৃত ইকুইটির পরিমাণ ৪৬১.৭৭ কোটি টাকা।
তাহলে ব্যাপারটি দাঁড়ালো, গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে অন্য একটি সেবাখাতের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে। আবার তারা তাদের লভ্যাংশ বিনিয়োগ করেছে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে।
বক্তব্যের তৃতীয় পৃষ্ঠায় তারা বলেছে, “গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়।” তারা যুক্তি দিয়ে বলেছে, যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম চুক্তিভিত্তিক, তাই তাদের নিয়োগও চুক্তিভিত্তিক।
তাদের এই বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে অসামঞ্জস্যতা। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ টেলিকম স্বীকার করে নিলো গ্রামীণ কল্যাণ তহবিলের টাকায় প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকম আদতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আইন অনুযায়ী, তাদের দাতব্য বা উন্নয়নমূলক কাজ করার কথা। নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও মিথ্যাচার করেছে গ্রামীণ টেলিকম। এ বিষয়ে দুটো যুক্তি অকাট্য। দুটো যুক্তিই মামলার নথি থেকে পাওয়া যায়।
প্রথম যুক্তি হলো- ২০২৩ সালের তরিকুল ইসলাম ও অন্যান্য বনাম গ্রামীণ টেলিকম ও অন্যান্য শীর্ষক ১৯০ নম্বর কোম্পানি মামলার হাইকোর্ট নথির ১১ নং পৃষ্ঠার Sheweth অংশের প্রথম বাক্যেই বলা আছে, মামলা দায়েরকৃত ব্যক্তিবর্গ কোম্পানির স্থায়ী কর্মচারী হিসেবেই মামলাটি দায়ের করেছে। সুতরাং, গ্রামীণ টেলিকম তাদের বক্তব্যে যে বলেছে, তারা কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে স্থায়ী করে না, বরং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়, এ দাবিটি মিথ্যা ও আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিমূলক।
দ্বিতীয় যুক্তি হলো- এ যুক্তিটি শ্রমিকের অধিকার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালা যে শ্রমিকদের কীভাবে বঞ্চিত করছে, তার প্রমাণ। শ্রমিক ঠকানোর জন্য তারা শিখণ্ডী হিসেবে শ্রম আইন ২০০৬ এর চতুর্থ ধারার কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু এ আইন তারা মানেনি। একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
শ্রম আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী শ্রমিকের যে শ্রেণিবিন্যাস দেওয়া আছে, সেখানে ‘চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক’ বলে কোনো কথা নেই, কোনো শ্রেণিবিন্যাসও নেই। এই আইনের ৫, ৬ ও ৭ ধারায় বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমিকের কাজের বণ্টন দেওয়া আছে। তৃতীয় শ্রম আদালতে দায়েরকৃত মামলা নং ৫৪৫ ও ৫৫৭ থেকে দেখা যায়, দুই মামলার বাদী গ্রামীণ টেলিকমে চাকরিরত ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও শহিদুল ইসলাম আদালতে অভিযোগ করে যে, তাদের পদবী স্থায়ী প্রকৃতির হলেও তাদের স্থায়ী করা হচ্ছে না; বরং চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির নামে তাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এটা শ্রম আইনের চতুর্থ ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
সুতরাং গণমাধ্যমে পাঠানো গ্রামীণ টেলিকমের বক্তব্যের মধ্যেই কিন্তু তাদের অপরাধ সুনির্দিষ্ট এবং তারা বক্তব্যের কোথাও এ অভিযোগ বিষয়ে কোনো আইনি ব্যাখ্যা দেয়নি। তারা কেবল শ্রম আইনের চতুর্থ ধারার ১ উপধারার কথা উল্লেখ করেছে, বাকি উপধারা যে তারা মানছে না, সে সম্বন্ধে কোনো বক্তব্য দেয়নি।
অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিল গঠন না করা এবং একটি বড়ো গোঁজামিল বক্তব্যের পঞ্চম পৃষ্ঠায় বলছে, তারা কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী মোট লভ্যাংশের ৫ শতাংশ WPPF প্রদান করেনি। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই টাকা তারা কোথায় খরচ করেছে? (আইন অনুযায়ী সামাজিক উন্নয়নে খরচ করার কথা)।
রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের আর্থিক প্রবাহ থেকে দেখা যাচ্ছে- এই টাকা প্রথমে গেছে ‘গ্রামীণ উদ্যোগ’ নামের প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকে গেছে ‘গণশিক্ষা-গ্রামীণ টেক্সটাইল মিল’ ও ‘গ্রামীণ শিক্ষা’ নামক প্রতিষ্ঠানে। আরও টাকা গেছে ‘গ্রামীণ সলিউশনস লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ আইটি পার্ক লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ-ডানো ফুড লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ ফেব্রিকস ও ফ্যাশন লিমিটেড’ ও ‘গ্রামীণফোন’ নামের কোম্পানিতে। টাকা গেছে ‘গ্রামীণ হেলথ কেয়ার সার্ভিস লিমিটেডে’। এখান থেকে টাকা গেছে ‘গ্রামীণ ভ্যেয়োলা ওয়াটার লিমিটেডে’। টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে ‘গ্রামীণ হেলথ কেয়ার ট্রাস্ট লিমিটেডে’। এর টাকা আবার বিনিয়োগ হয়েছে ‘বিএএসএফ গ্রামীণ লিমিটেডে’। টাকা গেছে ‘গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট’ নামক কোম্পানিতে। এর টাকা আবার গেছে ‘গ্রামীণ মৎস ও পশু সম্পদ ফাউন্ডেশনে’।
অর্থাৎ কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা ভঙ্গ করে তারা এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে (অনুদান নয় )। প্রতিটি কোম্পানি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, কারণ তাদের অডিট প্রতিবেদনে আরও বাণিজ্যিক বিনিয়োগের তথ্য আছে। অর্থাৎ যে আইনের দোহাই দিয়ে তারা শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলো না, সেই একই আইন ভঙ্গ করে তারা বাণিজ্যিক বিনিয়োগ করেছে।
গ্রামীণ টেলিকমের দেওয়া বক্তব্যের এই অংশে সবচেয়ে হাস্যকর যুক্তিটি উল্লেখ করেছে তারা। বক্তব্যের অষ্টম পাতায় তারা বলছে, “শ্রম আদালত ও মহামান্য হাইকোর্টে Company Matters No. 271 of 2022 এর ০৪/০৪/২০২২ ইং তারিখের আদেশ ও নির্দেশনা দেখে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষের মনে ভীষণ ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়... ২৮ ধারায় নট ফর প্রোফিট কোম্পানীর মুনাফা বিতরণযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ টেলিকম অনোন্যপায় হয়ে শ্রমিক-কর্মচারী ও সিবিএর সাথে Amicable Settlement out of court করে। এখন প্রশ্ন উঠেছে- গ্রামীণ টেলিকম যদি আইন অমান্য না-ই করে, তবে কেনো আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট করতে গেলো? তারা নিজেরাই বলেছে, কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় লভ্যাংশ দেওয়ার নিয়ম নেই বলেই তারা সেটা করেনি। যদি এই বক্তব্যের আইনি ভিত্তি থাকতো, তাহলে কোর্টের বাইরে শ্রমিকদের সাথে তাদের বসারই প্রয়োজন ছিল না।
আর যে আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, লভ্যাংশ বিনিময়যোগ্য নয়, সে আইনে নিবন্ধিত হয়ে তারা কীভাবে লভ্যাংশ বিনিময় করলো? তার মানে, এই আইনের কিছুই তারা মানেনি। কেঁচো খুঁড়তে সাপ যেন না বের হয়, তাই তারা আগেভাগেই আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট করে ৪৩৭,০১,১২,৬২১ টাকা প্রদান করেছে। গ্রামীণ টেলিকম বলছে, ভয়-ভীতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে তারা এই কাজ করেছে। এটা সবচেয়ে হাস্যকর। মামলা হয়েছে শ্রম আদালতে আর আদেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। গ্রামীণ টেলিকমের যদি নৈতিক জোর থাকতো, তবে তারা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারত। ড. ইউনূসই তো প্রথম আদালতে গিয়েছিলেন তার কর ফাঁকির মামলা নিয়ে। কিন্তু এই বেলা তারা আদালতবিমুখ হলেন কেন? ৪৩৭ কোটি টাকা কোনো কোম্পানি কখন কেবল ‘ভয়-ভীতির’কারণে দিতে পারে, যখন তাদের আরও হাজার কোটি টাকা থাকে অবৈধভাবে।
ড. ইউনূসের এমডি পদ বাঁচাতে আরেক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে গ্রামীণ টেলিকমের বক্তব্যের সর্বশেষ মিথ্যাচারটি গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে গেছে। ১৩ পৃষ্ঠায় গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ ধরে রাখার বিষয়ে ড. ইউনূসের বিধি-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সাফাই গাইতে গিয়ে, তারা আরেকটি অপরাধ কবুল করে নিয়েছে। তাদের বক্তব্য, ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৬০ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে”। ড. ইউনূসকে এমডির পদ থেকে যখন সরানো হয়, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের (তারা বলেছে ঋণগ্রহীতার) মালিকানা ছিল ৯৭% আর সরকারের ৩%। এই যুক্তি উত্থাপন করে তারা দাবি করেছে, “সরকারি চাকুরিবিধি অনুসরণের কোনো বাধ্য বাধকতা তাদের নেই।”বক্তব্যে গ্রামীণ টেলিকম দাবি করছে, এটা ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্যান্য ব্যাংকের মতো।
যে আইনে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, সে আইন ও প্রবিধান অনুযায়ী এটা Statutory Public Authority. এটা কোনোভাবেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান নয়।
গ্রামীণ ব্যাংক যেভাবে সময়ের সাথে সরকার ও তার সদস্যদের মধ্যে মূলধনের অনুপাতের তারতম্য ঘটিয়েছে, তা স্পষ্ট আইনের লঙ্ঘন। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক ও সরকারের মূলধনের অনুপাত হয় ৯৬.৭১% ও ৩.২৯%। এই অনুপাত গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, অর্থাৎ যে অধ্যাদেশের বলে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারই ৭ নম্বর ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
সুতরাং, তারা যে বলছে মূলধনে তাদের অনুপাত বেশি আর সরকারের অনুপাত কম বলে তারা সরকারি চাকরিবিধি মানতে বাধ্য নয়, এর গোড়াতেই আছে আইনের লঙ্ঘন। কারণ মূলধনের যে অনুপাতের দোহাই তারা দিচ্ছে, সেটাই অধ্যোদেশের সাথে সৃঙ্গতিপূর্ণ নয়। আইনের লঙ্ঘন এখানেই হয়েছে, পরের ধাপ তো পরে।
১৪ পৃষ্ঠার গোটা বক্তব্যে গ্রামীণ টেলিকম একাধিকবার স্বীকার করে নিয়েছে, তারা নানা ধরনের অসঙ্গতির ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা কোথাও এ কথা বলার নৈতিক সাহস পায়নি যে, তারা নির্দোষ। কিন্তু তারা চাইছে, এগুলোর বিষয়ে ফৌজদারি আইনে মামলা না চলুক; বরং তারা একে ‘বিরোধ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নিষ্পত্তি করতে চাইছে।
গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো এই ১৪ পৃষ্ঠার বক্তব্যে আদতে তাদের লেজেগোবরে অবস্থাই প্রকাশ পেয়েছে, কারণ না তারা তাদের পক্ষে কোনো আইনি যুক্তি হাজির করতে পারছে, না পারছে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের কোনো সৎ যুক্তি উপস্থাপন করতে। ফলে নানা তথ্য গোপন করে আর আইনের খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়ে গ্রামীণ টেলিকম নতুন করে নিজেদের অপরাধগুলো সামনে তুলে এনেছে। তারা যে ধরনের যুক্তি তুলে ধরেছে, তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সেগুলোরও কোথাও কোথাও আইন অমান্যের ঘটনা ঘটেছে। গ্রামীণ টেলিকম নিজেদের সাফাই গাইবার জন্য যে ১৪ পৃষ্ঠা বক্তব্য তৈরি করে গণমাধ্যমে পাঠালো, চাইলে এর মধ্যে থেকেই তাদের অপরাধগুলোর নানা পোক্ত প্রমাণ খুঁজে বের করা সম্ভব। তাছাড়া বিচারাধীন একটি বিষয় নিয়ে গ্রামীণ টেলিকম যেভাবে তথ্য গোপন করেছে, সেটাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available