এইচ এম জহিরুল ইসলাম মারুফ: তাকওয়া শব্দের মূল অর্থ বেঁচে থাকা, সাবধান থাকা বা সাবধান করা। কুরআন মজিদে এ শব্দটি আল্লাহকে ভয় করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ইসলামের পরিভাষায় তাকওয়ার অর্থ আল্লাহভীতি। আর যে তাকওয়া অর্জন করে বা তাকওয়া সম্পন্ন হয় তাকে বলে মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু।
এ তাকওয়া বা আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে সকল প্রকার খারাবী থেকে দূরে রেখে সকল অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করে আশরাফুল মাখলুকাতে পরিণত করতে। তাই তো আল্লাহ্ তাআলা কুরআনের পাতায় পাতায় তাকওয়া অনুশীলনের আলোচনা করেছেন।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের স্পষ্ট নির্দেশ, 'তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।' (আল ইমরান: ১০২)
সততা, সুবিচার, সহানুভূতি, দয়া-দানশীলতা, উদারতা, আত্মসংযম, দায়িত্ববোধ, ভাষার মিষ্টতা, সত্যবাদিতা- সব কিছুর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়ার গর্ভেই জন্ম নেয় সর্বপ্রকার কল্যাণ ও মঙ্গলময় বিষয়সমূহ।
হযরত ওমর (রা) এর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, সংকীর্ণ রাস্তার দু'পার্শ্বে কাটাওয়ালা গাছ থাকলে পরিধেয় কাপড় সযত্মে গুটিয়ে নিয়ে খুব সাবধানে যেমন পথ চলতে হয়, তেমনি পাপ-পঙ্কিল পৃথিবীতে চলতে গিয়ে অতি সাবধানে আমাদের পা ফেলতে হবে, যাতে পাপ বা আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে জড়িয়ে না পড়ি- এর নামই তাকওয়া।
যারা নিজেদের জীবনে তাকওয়া অর্জন করেছে তারাই মুত্তাকী। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, এ কিতাব আল্লাহর কিতাব, এতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। এটা পথ প্রদর্শক মুত্তাকীদের জন্য। (সূরা বাকারা: ১)
মুত্তাকীদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘মুত্তাকী তারা, যারা গায়েবে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে, আমি যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে, যে কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছে সে সবের প্রতি বিশ্বাস করে এবং পরকালের প্রতি যাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।’ (সূরা বাকারা: ২-৪)
সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা পূর্বদিকে মুখ করলে ও পশ্চিম দিকে মুখ করলে তা কোনো প্রকৃত পুণ্যের কাজ নয়; বরং প্রকৃত পুণ্যের কাজ হচ্ছে, তোমরা আল্লাহকে, পরকাল ও ফেরেশতাদের এবং তোমার রবের অবতীর্ণ কিতাব ও তাঁর নবীগণকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে মান্য করবে। আর আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রিয় ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকিন, পথিকের জন্য, সাহায্যপ্রার্থী ও ক্রীতদাসদের জন্য ব্যয় করবে। এ ব্যতীত নামাজ কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। প্রকৃত পুণ্যবান তারাই, যারা ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করে, দারিদ্র্য, সংকীর্ণতা ও বিপদের সময় এবং হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে পরম ধৈর্য অবলম্বন করে। বস্তুত এরাই প্রকৃত সত্যপন্থি, এরাই মুত্তাকী।
এরাই মুত্তাকী এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সকল প্রকার সফলতা এদেরই জন্য। কুরআন মজীদে অসংখ্যবার মুত্তাকীদের জন্য সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আখিরাতের সকল নিয়ামত আল্লাহ্ তাআলা মুত্তাকীদের জন্যই নির্ধারিত করেছেন। যেমন কুরআনের ঘোষণা, 'আখিরাতের ঘর তাদের জন্য, যারা প্রাধান্য বিস্তারের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি। আর উত্তম বিনিময় রয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।' (সূরা কাসাস: ৮৩)
মুত্তাকীদের দলে দলে সসম্মানে জান্নাতের দিকে নেওয়া হবে। (সূরা যুমার: ৭৩)
দুনিয়ার জীবনেও মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি সংকটে সংঘাতে, বিপদে-মসিবতে, অভাবে-অভিযোগে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দাদের সাহায্য করার ওয়াদা এবং ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের দুনিয়ার যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি দেবেন, যা তারা ভাবতেও পারে না। (সূরা তালাক: ২-৩)
তাকওয়া কোনো বস্তু নয়, কোনো অভ্যাস নয়, কিংবা কোনো গুণের নামও নয়। চর্চা বা অনুশীলনের সাথে নয় তাকওয়ার সম্পর্ক বিশ্বাসের সাথে, ঈমানের সাথে। তারপরও তাকওয়া আপনা-আপনিই কারো মধ্যে সৃষ্টি হয় না। অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টির জন্য সাধনার প্রয়োজন। তাকওয়া অর্জনের জন্য প্রথম প্রয়োজন ইলম- অধিক পরিমাণ কুরআন পড়া, হাদীস পড়া, কুরআন-হাদীস বুঝতে বোঝাতে সহায়ক বইপুস্তক পড়া। এর কোনো বিকল্প নেই। অজ্ঞানতা হলো তাকওয়ার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। আর জ্ঞানের মূল উৎসই হচ্ছে আল কুরআন। ‘আল্লাহ সম্পর্কে, আখিরাত সম্পর্কে, জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কখনো এক হতে পারে না। জান্নাতগামী লোকেরাই প্রকৃতপক্ষে সফলকাম।’ (সূরা হাশর: ২০)
আর জান্নাতগামী তো মুত্তাকীরাই। ইলম অর্জনের পর তাকওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে, 'অর্জিত ইলমের উপর অবিচল বিশ্বাস বা দৃঢ় ঈমান। ঈমানহীন ইলম কখনো মানুষকে মুত্তাকী বানাতে পারে না। তাই তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন মজীদে মুত্তাকীদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই গায়েবে বিশ্বাস, শেষে আখিরাতের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাসের কথা বলেছেন।
তাকওয়া অর্জনের তৃতীয় মাধ্যম সিয়াম পালন করা। তাকওয়ার সবচেয়ে বড় দুশমন নফসে আম্মারা। সিয়াম নফসে আম্মারাকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদের জন্য সিয়াম ফরয করেছি, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয করেছিলাম, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)
সাহাবীগণ তাঁর কাছ থেকে সরাসরি শিখেছিলেন, কী করে আল্লাহকে ভয় করতে হয়। তাই তো হাজরা মাউত থেকে সানা পর্যন্ত অলংকারে সজ্জিত কোনো সুন্দরী নারী একাকী সফর করলে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করার প্রয়োজন হতো না। এমন একটি সমাজ গড়ে উঠেছিল শুধু তাকওয়া বা আল্লাহভীতির উপর ভিত্তি করে।
তাকওয়াই পারে মানুষকে দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি দিতে। তাকওয়া অর্জনই হোক আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দিলুরোড মাদরাসা, মগবাজার, ঢাকা।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available