ফাতিমা জোহরা, একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি ‘গয়নার বাক্স’ নামে এমিটেশন গয়নার একটি অনলাইন বিজনেস শুরু করেন তিনি। ভারত ও চায়না থেকে আমদানির পাশাপাশি নিজস্ব কারিগর দিয়ে গহনা তৈরি করে পেয়েছেন সফলতা। সফল হয়ে ওঠার নানা গল্প নিয়ে এশিয়ান টিভি অনলাইনের সাথে কথা হয় এই নারী উদ্যোক্তার। আলাপচারিতায় ছিলেন নুরুল ইসলাম।
প্রশ্ন: কখন ও কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ চলা শুরু হলো?
ফাতিমা জোহরা: ২০১৩ থেকে পথ চলা শুরু, তখন আমি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। থিসিসের পাশাপাশি গয়না ক্রাফটিং শুরু করি। আমার উদ্যোগটি তখন সহপাঠী, প্রতিবেশী এবং ফেসবুক বন্ধুদের কাছে প্রসংশিত হয়। অনেকেই কিনতে আগ্রহী হন। অন্যদের আগ্রহ দেখে তখনই ফেসবুক পেজ খুলি এবং সেই থেকেই শুরু।
প্রশ্ন: অনুপ্রেরণা কোথায় কীভাবে পেয়েছিলেন?
ফাতিমা জোহরা: মূল অনুপ্রেরণা ছিল নিজের মধ্যেই। ভাবনা ছিল, আমাকে নিজে কিছু করতে হবে। চাকরি করার গতানুগতিক ধারণা থেকে বের হয়ে নিজে কিছু করব, নিজের ভালোলাগার কাজটা সবার মাঝে পৌঁছে দিব, এটাই ছিল আমার আগ্রহ এবং স্বপ্ন। হয়তো যেভাবে যা করব ভেবেছিলাম, সেভাবে হয়নি, কিন্তু শুরু করেছিলাম বলেই বুঝতে পেরেছিলাম কীভাবে, কোন পথে এগিয়ে যাব। আমি অবশ্যই শিখে-পড়ে আসিনি। তাই বার বার ভুল করেছি। প্রতারিত হয়েছি, লস দিয়েছি। এভাবে ঠেকে ঠেকেই শিখেছি কীভাবে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যেতে হবে, নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই এখন এগিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: এ পথ চলার গল্পটা বলুন।
ফাতিমা জোহরা: শুরুটা খুব বেশি কিছু ভেবে করা হয়নি, ভালোলাগা থেকেই শুরু। ছোটবেলা থেকে ক্রাফটিং ভালো লাগত, বাইরে থেকে গয়না কিনে এনে নিজের মতো করে পাথর-পুঁথি বদলাতাম, চুরিতে নকশা করতাম। নিজের গয়নার জন্যই এরপর চায়না থেকে ভালো মানের পাথর-বিডস আনাই, তখনই বুঝতে পারি দেশে ভালো মানের ইউনিক গয়নার চাহিদা প্রচুর। এই চাহিদাটা ধরেই এগিয়ে যাওয়া মূলত।
প্রশ্ন: কী কী প্রতিবন্ধকতা ছিলো সেখানে?
ফাতিমা জোহরা: কাজের প্রশংসা পেলেও শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। বিজনেস সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না, কীভাবে কী করতে হবে সেটা নিজেই শিখেছি। নতুন পেজকে দাঁড় করানোর জন্য প্রায় সারাদিন ফেসবুকে কন্টেন্ট রাইটিং, পোস্ট শেয়ারিং করতে হতো। আমার স্টার্টিং বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৪ হাজার টাকা, তাই প্রোডাক্ট মেকিং, ফটোগ্রাফি সব নিজেই করতাম। ভালো মানের ক্যামেরা বা মোবাইল না থাকায়, অন্যের মোবাইল/ক্যামেরা ধারে এনেও ফটোগ্রাফি করতাম। তখন ভালো মানের লজিস্টিক সার্ভিসও ছিল না। দেখা যেত ঢাকার ডেলিভারিগুলো নিজেই দিতাম। এমনও দিন গিয়েছে কাস্টমারের জন্য প্রোডাক্ট রেডি করতেই টাকা শেষ, ডেলিভারি কমপ্লিট হওয়ার আগ পর্যন্ত পেমেন্ট পাব না, কাস্টমারের লোকেশন পর্যন্ত তখন হেঁটেই যেতাম। কিন্তু এত কষ্ট করার পরও খারাপ লাগতো না, ভালো কাজ করার এবং মানুষের কাছে আমার কাজটা পৌঁছে দেওয়ার নেশাই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যেত। এখন ২ জন মডারেটর কাজ করেন, ২ জন কারিগর আছেন। দেশ ছাড়িয়ে প্রবাসীদের কাছে আমার গয়না এখন ভীষণ জনপ্রিয়।
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল মানুষের নানান কথা। কাছের মানুষরাই বলত, ‘প্রকৌশলী হয়ে ফেসবুকে গয়না বেঁচবা?’। তখনো ‘অনলাইন বিজনেস’ শব্দটার এতটা প্রচলন হয়নি এবং অনেকেই অনলাইন বিজনেসকে খুব ছোট করে দেখতেন। হোল সেলাররা ডিরেক্ট বলে দিত, ‘অনলাইন সেলারদের পণ্য দেই না’। আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমারই পণ্য কিছু শপ আর পেজে হোলসেলে যায় রিসেলের জন্য। এছাড়াও প্রিম্যাচিউরড বেবির মা হওয়ার কারণে অনেক পিছিয়ে পরেছিলাম, নারী হওয়ার কারণেও কম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু সব সময় পরিশ্রম দিয়ে লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে গিয়েছি। এখনও প্রতিনিয়ত আমি শিখছি।
প্রশ্ন: স্বপ্ন বা ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বলুন।
ফাতিমা জোহরা: আমার স্বপ্ন এবং লক্ষ্য দেশীয় গয়নার প্রোডাকশন বাড়ানো। প্রায় ৭০-৮০% গয়নাই বাইরে থেকে আমদানি হয়। আমাদের দেশে গয়না বানানোর কাঁচামাল এবং ভালো মেশিন নেই বললেই চলে। আমি চাই দেশেই বৃহৎ পরিসরে গয়না প্রোডাকশন হোক, যাতে এই আমদানি কমিয়ে আনা যায় এবং আমাদের দেশীয় গয়নার সাথে বাইরের দেশগুলোকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।
প্রশ্ন: নতুনদের উঠে আসার ব্যাপারে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়ার আছে বলে মনে করেন?
ফাতিমা জোহরা: নতুনদের এগিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্রের কিছু সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই বৃদ্ধি করা দরকার। অনলাইন বিজনেস নীতিমালা সেট করে দেওয়া, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই প্রতারণার শিকার না হন। এখন অনলাইন বিজনেসের ভিন্ন ধরনের ট্রেড লাইসেন্স খুব প্রয়োজন। অ্যাপস-সেন্সর নিয়ন্ত্রিত উন্নত মানের সরকারি লজিস্টিক সার্ভিস প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের পণ্যের বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা, কম্পিটিশনের আয়োজন করা, যাতে এই উদ্যোগ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এগুলো করা গেলে বেকারত্ব অনেক কমে আসবে এবং বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন হবে।
প্রশ্ন: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ
ফাতিমা জোহরা: যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চাচ্ছেন, তাদের ভেবে-চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্য কেউ যে পথে সফলতা পেয়েছে সেটাই বেছে নেবেন না! যে কাজটা আপনার ভালো লাগে, যে বিষয় সম্পর্কে আপনি জানেন, সেটাই বেছে নেবেন। আপনার কাজটা কেন ইউনিক, কেন সেরা, সেটা সকলের কাছে পৌঁছাতে আপনাকে অনেক পরিশ্রম, দক্ষতা এবং বিনয়ের পরীক্ষা দিতে হবে। এগুলোর কোনো বিকল্প নাই।
অনলাইন বিজনেসের জন্য ভালো মানের লজিস্টিক সার্ভিস ব্যবহার করবেন। কারণ, এরাই আপনার বিজনেসের দ্বিতীয় ফেইস। আর প্রথম ফেইস হচ্ছে আপনার বিক্রির মাধ্যম; সেটা হতে পারে ফেসবুক পেজ, গ্রুপ অথবা হোয়াটসঅ্যাপ। এই মাধ্যমগুলোতে আপনাকে রেগুলার আপডেট দিতে হবে। প্রথমেই অর্ডার এবং সেলের হিসাব না করে, প্রতিদিন আপডেটেড রাখতে হবে। টাইমলি বিনয়ের সাথে কাস্টমার হ্যান্ডেল করতে হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available