মো. মাইনুল হক, নীলফামারী: ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এর ব্যতিক্রম নয় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও। এক সময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এখন জনরোষের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ডিমলা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার শেখ হাসিনার পতনের কয়েক ঘণ্টা পূর্ব থেকেই পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে পালিয়ে ভারত চলে গেছেন। বর্তমানে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মিকলিগঞ্জ সোনাপুরে অবস্থান করছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক সরকার (মিন্টু) গণধোলাই থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল, সীমান্তে চোরাচালান, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপকর্মের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সরকার পতনের পর তিনি দুই দিন উপজেলা পরিষদের অফিস করার জন্য গেলে বিক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে পালিয়ে যান। এরপর থেকেই গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দেয়ার পর তিনি কল কেটে দেন।
সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ মো. লুৎফর রহমান পেশায় একজন শিক্ষক। শিক্ষকতা ও দলীয় পদবীকে হাতিয়ার করে উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা ও হয়রানির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। বেশিরভাগ সময় স্কুলে উপস্থিত না থেকে দলীয় কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্কুল ফান্ড থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। লুৎফরের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তার লোকজন দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালাতেন। তাই তার এসব অপকর্ম দেখেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ভয়ে চুপ থাকতেন। বর্তমানে তারও কোনো খোঁজ নেই।
উপজেলার মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহবায়ক ফেরদৌস পারভেজ। উপজেলার সমস্ত সরকারি-বেসরকারি অফিসে তার একক আধিপত্য ছিল। নিজস্ব ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তৈরি করেছিলেন সন্ত্রাসী বাহিনী, এলাকায় যা আগুন খাওয়া টিম নামে পরিচিত। এ টিমের মাধ্যমে মাদক কারবার থেকে শুরু করে জমি দখল এমনকি সাধারণ মানুষকে সামান্য বিষয় নিয়ে মারধরসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার।
সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুল বারী সূর্যকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রকাশ্যে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে আগুন খাওয়া টিমের লোকজন। এছাড়াও আলম মিয়া (৩২) নামে এক যুবককে পারভেজ ও সায়েমের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা রাশেদুল ইসলাম রাশেদকে তুলে নিয়ে বেধড়ক পিটুনি দেয়।
এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী আলম মিয়ার সঙ্গে কথা হলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, কাউসার মোড় থেকে আমাকে তুলে নিয়ে পারভেজের অফিসে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। সেখানে আমার চোখে আঘাত করে বাম চোখ নষ্ট করে দেয়। বর্তমানে আমি বাম চোখে কিছুই দেখতে পারি না।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন পারভেজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মুঠোফোনেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবু সায়েব সরকার নিজেকে সাবেক সংসদ সদস্যের ভাতিজা পরিচয় দিয়ে একের পর এক অপকর্ম করে গেছেন। উপজেলায় মাদক সম্রাট হিসেবে তাকে চিনতেন সবাই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় রাতের আঁধারে ভারত সীমান্ত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নিষিদ্ধ নেশাজাতীয় দ্রব্য চোরা-চালান করতেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পদ-পদবীর লোভ দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার বাহিনী দিয়ে স্কুলের নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করারও অভিযোগ আছে। জনরোষের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনিও।
উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) উত্তম কুমার রায়। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকা অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন একের পর এক অপকর্মে। সাইফুল ইসলাম নামে এক উঠতি বয়সী যুবককে জিনের বাদশা বানিয়ে দেশব্যাপী প্রতারণার জাল বিছিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নিজস্ব কর্মীদের বিনামূল্যে মাদক সাপ্লাই দিতেন। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করতেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিমলা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রাব্বানী প্রধান বলেন, এরা যে নৈরাজ্য, অপকর্ম চালিয়েছে তা সারাদেশ এমনকি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। তারা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে জমি দখল, দোকান দখল এমনকি মেধাবী শিক্ষার্থীদের চাকরি পর্যন্ত দখল করেছে। আর সেজন্যেই দেশের জনগণ এক হয়ে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিমলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেবাশীষ কুমার রায় বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মাদক ও চোরাচালানের সাথে কেউ জড়িয়ে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available