শাফি উদ্দিন আহমদ: সীমাহীন লুটপাটের কারণে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত আর্থিক খাতের করুণ পরিণতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা। বিগত দুই গভর্নর ফজলে কবীর ও আব্দুর রউফ তালুকদারের সব উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবে এবার খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই লুটপাটের চিত্র বেড়িয়ে এসেছে। ডেপুটি গভর্নর নির্বাচনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটির কাছে কর্মকর্তাদের লুটপাটের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই কিছু কর্মকর্তা। সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে কিছু কর্মকর্তার ভয়াবহ লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা আর জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ার গুরুতর অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারে ছত্রছায়ায় লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়েছেন নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায়, মেজবাউল হক ও আনোয়ারুল ইসলাম।
চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ১৫ বছরে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়েছে। নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক রিজার্ভ চুরির তালিকাভুক্ত আসামি। একই সঙ্গে তিনি দুর্নীতির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের বাণিজ্যিক দালাল ও টাকা পাচারকারী।’ এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির তোয়াক্কা না করে বিকাশের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের পরিকল্পনা করার অভিযোগ রয়েছে মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে। রিজার্ভ চুরির পরে তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান রাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির পরামর্শে বিজার্ড চুরির এই সংবাদ এক মাসের মত গোপন রাখেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক রাকেশ আস্তানার মাধ্যমে আইসিটি আলামত নষ্ট করেন। সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে রিজার্ভ চুরির আলামত নষ্টের সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতের আইসিটি ব্যবসার জন্য সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক তার ঘনিষ্ঠজন দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ‘ফাংশনালিটি’; বিশেষ করে পেমেন্ট সিস্টেমস ও সিআইবি বাণিজ্যিকিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসমস্ত কাজ বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
অপরদিকে ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সুইস স্থাপনের জন্য জয়, দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের যোগসাজশে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকৃত খরচের চেয়ে ২০ গুণ অর্থ ব্যয় করে বিনিময় প্রকল্প শুরু করা হয়। এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের (ভেলওয়াইর) সঙ্গে অর্ধেক লভ্যাংশ শেয়ারের জন্য একটি চুক্তি করা হয়।
বর্তমানে ভারতের টাইম ইন্ডিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘টাকা পে ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড’ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ মালিকানায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভারতের যেকোনো এআইএম থেকে টাকা উত্তোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল পেমেন্টস করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এনপিসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ডেটা সেন্টারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের কাজ চলমান আছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যবসায়ীক ক্ষেত্র বৃদ্ধির জন্য দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের সকল (এনআইএসবি, ইএফটি, বিএসিএইচ) ফাংশন বেসরকারিকরনের জন্যে এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি আভ্যন্তরীণভাবে প্রায় শেষের দিকে রয়েছে। তবে এ বিষয়ে দাপ্তরিক কোনো সার্কুলার হয়নি।
চিঠিতে বলা হয়, দেবদুলাল ও আটক হওয়া প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক একই স্কুলের ছাত্র হওয়ায় পলক, দেবদুলাল ও মেজবাউল হককে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং সেক্টরের আইসিটি খাত নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ক্রয় কাজে সিন্ডিকেট তৈরি করেন। এছাড়াও সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী পুত্র, দেবদুলাল ও মেজবাউল হক মিলে পেমেন্ট সিস্টেমস এবং আইসিটি বিভাগের সকল ক্রয় সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন আইসিটি পণ্যের উৎপাদক, ডিস্ট্রিবিউটর ও সরবরাহকারী মিলে এক অবিচ্ছেদ্য সিন্ডিকেট করে ১ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করা হয়।
দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা সেন্টার বেসরকারি খাতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল আইসিটি সিস্টেমস কেনাকাটা দেবদুলালের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। প্রকিউরমেন্ট সেকশনটি তার সহযোগী জনবল দিয়ে সাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেকশনের উপর থেকে নিচের সকল কর্মকর্তার তালিকায় আছে আইসিটি বিভাগের ২ জন পরিচালক (৩য় গ্রেড)। তারা হলেন- চন্দন সাহা ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক। এ ছাড়া অতিরিক্ত পরিচালক বিষ্ণু পদ বিশ্বাস, যুগ্ম পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র মন্ডল, উপপরিচালক মিথুন সরকারের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট।
এদিকে ব্যাংক খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘সিআইবি’। সিআইবিকে ব্যবসায়ীক স্বার্থে ব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিলাষে বেসরকারি খাতে দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে অযাচিতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট থেকে সার্কুলার করা হয়েছে। দেবদুলাল সিআইবি-সফটওয়্যারে সকল কন্ট্রোল নিয়ে কর্মকর্তাদের কর্মহীন করে রেখেছেন। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ তথ্য আপডেট করার ও সিস্টেমে তা নয়-ছয় করার সুযোগ দিয়ে এর কন্ট্রোল দেবদুলালের হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে চলমান সিবিএস ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টাটা কনসাল্টিং সার্ভিসেস (আইসিএস) থেকে ক্রয় করা। মেজবাউল হক এবং দেবদুলাল রায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এ কাজ করেছেন বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে। গত ১৬ বছর ধরে এই সফটওয়্যার (টিসিএস, সিবিএস) সার্ভিস চার্জের নামে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অনসাইট সার্ভিস দেবার জন্যে ভারতীয়দের ব্যাংকের ভেতরে ওয়ার্ক ভিসা ছাড়াই কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ফাইনান্সিয়াল ডেটা ভারতের কাছে অবাধে চলে যাবার ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়নি। এই সফটওয়্যার (সিবিএস) বাংলাদেশ ব্যাংকের আইসিটি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তৈরির সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেবদুলাল রায় গত ১২ বছর ধরেও বাস্তবায়ন হতে দেননি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমকে পরোক্ষভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীল রাখার অপচেষ্টা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বিতর্কিত এস আলমের এজেন্ট হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কয়েকবার শাস্তিমূলক বদিলী করার পরও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তিনি প্রচুর অবৈধ টাকার মালিক ও ব্যাংকের স্বার্থ বিরোধী কাজে পটু। বাংলো বাড়ি, দামি গাড়ি এসব তিনি ফেসবুকে প্রতিনিয়ত প্রচার করে বেড়ান। এমন পরিস্থিতিতে এ কর্মকর্তার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করা হয়েছে চিঠিতে। এছাড়া দেবদুলাল, আনোয়ারুল ইসলাম ও মেজবাউল হককে ডেপুটি গভর্নর পদে পদোন্নতি না দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার অনুরোধও করা হয়। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তারা কেউ সাড়া দেননি।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক রয়েছেন। এরপর অজ্ঞাত স্থান থেকে ইমেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।
চিঠিতে আরও কিছু দাবি জানান কর্মকর্তারা। এর মধ্যে রয়েছে, রিজার্ভ চুরির অধিকতর ইনেভেস্টিগেশন করে যারা আওয়ামী সরকারের সহায়তায় এই তালিকা থেকে অব্যাহতি নিয়েছে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফাংশনালিটিকে’ বাণিজ্যিকীকরণের কুশীলবদের বরখাস্ত এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ ব্যাংকে যাদের সহায়তায় মানিলন্ডারিং, ব্যাংকগুলো থেকে অর্থলুণ্ঠন, আইসিটি খাতে অযাচিতভাবে পণ্য ক্রয় করে জাতীয় সম্পদের অপচয় করেছে তদন্ত করে তাদের চাকুরিচ্যুত ও শাস্তি নিশ্চিত করা।
ভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন আইিসিট পণ্য ক্রয় করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের নিরাপত্তায় ঝুঁকি সৃষ্টিকারী ও পণ্য ক্রয়ের নামে অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চাকুরিচ্যুত ও শাস্তি দেওয়া। গত ১২ বছর ধরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিবিএস তৈরি না করে ভারতীয় সফটওয়্যার আইসিএস-সিবিএস চালিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমকে পরোক্ষভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীল রাখার বিষয়টি তদন্ত করা ও শাস্তির ব্যবস্থা করা। জয়কে বাণিজ্যিক সুবিধা দেবার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমকে অর্থাৎ পেমেন্ট সিস্টেমসকে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ কেনো করা হল তার জন্য দেবদুলাল, মেজবাউল হক এবং সংশ্লিষ্ট সহযোগী অন্যান্য কর্মকর্তাকে কৈফিয়ত তলব করে তদন্ত করা ও শাস্তির আওতায় আনা এবং দেবদুলাল, আনোয়ারুল ইসলাম ও মেজবাউল হকের শত শত কোটি টাকা লুটের বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available