ইবি প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করে তাদের সাথে এক প্রকার মশকরায় লিপ্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেশন জট, বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানসহ নানা অভিযোগ করছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। সেই সাথে সেমিস্টারের দীর্ঘসূত্রিতা, বিভাগের শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। জনবল সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স সেলের কার্যক্রম এখন শূন্য। সেলটির পরিচালক থাকলেও নেই নির্দিষ্ট দফতর। সেলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখলেও সেখানে পাওয়া যায় না সংশ্লিষ্ট কাউকে। যার ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়তে এসে একরকম বিপাকেই পড়েছেন অসহায় এই ভিনদেশী শিক্ষার্থীগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা যায়, সর্বপ্রথম ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি শুরু হয়। সে সময় অনার্সে ১ জন, মাস্টার্সে ৪ জন এবং এম.ফিলে ২ জনসহ মোট ৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ফরেন স্টুডেন্টস সেলের কার্যক্রম শুরু হয়। ধীরে ধীরে পরবর্তী বছরগুলোতে এই বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে অনার্স ও মাস্টার্স মিলে ২২ জন, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সর্বপ্রথম পি.এইচ.ডি স্টুডেন্টসসহ ১৭ জন শিক্ষার্থী, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ১৪ জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হয়।
করোনা পরবর্তীতে তার ঠিক পরের শিক্ষাবর্ষ ২০২০-২১ এ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তিতে ধস নামে। স্নাতকে মাত্র ১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় সে বছর। সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫ জন শিক্ষার্থীসহ এযাবৎ মোট ৬৬ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি সম্পন্ন করেছে। তবে সেশন জটিলতায় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে কোনো বিদেশি ভর্তি করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। মুদ্রার উল্টো পিঠে ভর্তি হয়েও নানা জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে ২২ জন শিক্ষার্থী যার আনঅফিসিয়াল হিসাব তারও অধিক। সর্বশেষ গাম্বিয়া থেকে আগত ইইই বিভাগের আমাত সেকা ভর্তি বাতিল না করেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে। যার মূল কারণ ছিলো ক্লাসে শিক্ষকদের বাংলা ভাষায় পড়া বোঝানো। এছাড়াও সোমালিয়া, নাইজেরিয়া থেকে বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীই ডিগ্রী সম্পূর্ণ না করেই ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন।
ইবিতে মূলত ভারত, নেপাল, গাম্বিয়া, সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার শিক্ষার্থীরা উচ্চাশিক্ষা অর্জন করতে আসে। বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনাম দেখে পড়ার আগ্রহ পায় তারা। এছাড়াও নামমাত্র খরচে বাংলাদেশে এসব বিদেশি শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর তারাই প্রশ্ন তুলেছে শিক্ষার মান নিয়ে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ক্লাসে এসে শিক্ষকরা বাংলায় ক্লাস নেন। বারবার বলার পরও শিক্ষকরা ইংরেজিতে লেকচার দেন না এবং পরবর্তীতেও আলাদাভাবে তাদের বুঝিয়ে দেন না।
কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের বিদেশি শিক্ষার্থী সাজিদ রাইন অভিযোগ করেন, আমরা নেপালি ভারতীয়রা কিছু দিন পর বাংলা বুঝে যাই কিন্তু যারা আফ্রিকা থেকে আসে তাদের পক্ষে এটা দূর্বোধ্য। শিক্ষকদের উচিত বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে আমলে নেয়া। এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষকই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। এক একটা সেমিস্টারের রেজাল্ট দিতে সময় লাগায় দুই মাসের অধিক। যার ফলে আমরা সেশনজটে ভুগি। আমরা বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে কোনো শিক্ষকের নিকট থেকে আলাদা সৌহার্দ পাইনা। বিদেশ থেকে এসে আমাদের পক্ষে ৬ বছরে স্নাতক সম্পূর্ণ করা অভিশাপের মতোই। ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ পেলে আমিও এখান থেকে চলে যাবো সেই সাথে আমাদের সকল কমিউনিটিকে অনুরোধ করবো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসতে।
এছাড়া শুধু সেশন জট, ভাষা বৈষম্যই নয় বিদেশিদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থাতেও রয়েছে নানা সমস্যা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হলের আন্তর্জাতিক ব্লকে ওয়াইফাইয়ের সমস্যা দীর্ঘ দিন ধরে চলে। যার কোনো স্থায়ী সমস্যা দিতে পারেনি হল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে হলের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। পানির ফিল্টার পরিষ্কার, প্রবেশপত্র উত্তোলনসহ যে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দরকারে তাদের কাছে গেলে পেতে হয় তিরস্কার। মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহারের শিকার হয়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সেলের লোকবল নিয়েও। ছাত্রী হলে বরাদ্দ নেই আলাদা বিদেশি শিক্ষার্থীদের সিট। যার ফলে দেশীয় ছাত্রীদের সাথে বেড শেয়ার করে থাকতে হয় তাদের। এতে বিভিন্ন সময়েই নানা ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছে উভয়পক্ষই।
ফার্মেসি বিভাগের নেপালের আরেক শিক্ষার্থী ইরফান বলেন, আমরা পরীক্ষার প্রবেশপত্র স্বাক্ষর করাতে গেলে অফিসের স্টাফ আমাদের কোনো প্রাধান্য না দিয়ে তাদের কাজে ব্যস্ততা দেখায়। আমাদের ওয়াইফাই নষ্ট, ডাটা কিনে পরিবারে ফোন করতে হয়, বিভিন্ন সময় অনলাইন ক্লাস করতে হয় যার দামও অনেক। পানির ফিল্টার দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে থাকে। বারবার অভিযোগ করে কোনো সমাধান না পেয়ে আমরা স্যারের কাছে যাই। বাবা মা আমাদের এখানে পড়তে পাঠিয়েছে কতো স্বপ্ন নিয়ে তবে আমাদের কাছে এই পরিবেশ গুলো দু:স্বপ্নের মতো। আমাদেরও যদি এখন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয় তাহলে এর থেকে খারাপ হয়তো কিছু হবেনা।
তবে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যও অনেকটা অনিশ্চয়তায় ফেলে এই শিক্ষার্থীদের। ফরেন স্টুডেন্টস সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু হেনা মোস্তফা জামাল বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ এখানে দুইটি। একটি কারণ হচ্ছে, একজন এসে এখানে ডিগ্রি করবে সেখানেও কিন্তু প্রসিডিউর আছে সেইটা মেইনটেইন হচ্ছে কিনা সেটা আমি জানি না। তবে যখন আমরা তাদের ভেরিফিকেশনের কাগজ চাচ্ছি বা অন্যান্য কাগজগুলো চাচ্ছি তখন পরবর্তীতে স্টুডেন্ট টি আর আবেদন করছে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে প্রশাসনের উদাসিনতা। কারণ আমাদের যে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স আছে ওখানে কোনো স্টাফ নাই সেখানে একটি ছেলে ডে লেবারে কাজ করতো নাম মনজুরুল, এই প্রশাসন আসার পর তার বেতনটিও বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও তাকে ফ্রি ফ্রি তো আর কাজ করাতে পারছি না। তারপর আমাদের কোনো অফিসার নাই। একজন আছেন উনি আবার একাডেমিক দফতরের এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার।
হলের বিষয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা হলে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট রুম থাকার কথা। কিন্তু আমাদের যে মেয়ে স্টুডেন্ট তাকে অন্যদের সাথে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে। সেখানেও অনেক ঝামেলা চলছে। বিভাগ গুলোর বিষয়ে, আমি অনেকবার বলেছি এখানে ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থী আছে আপনারা ইংলিশে ক্লাস নেন। আমি একটি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানকে যখন এই কথা বলি তখন সে বলে আমি একজনের জন্যতো বাকি স্টুডেন্টের ক্ষতি করতে পারি না। এইটা একটি ইউনিভার্সিটি, সেখানে আপনি ইংলিশে ক্লাস নিবেন না কেনো। কমপক্ষে ১০ মিনিট সময় ঐ বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য রাখেন। তাকে বুঝিয়ে দেন। এখন নেপালীরা আসলে কিছু দিন পর বাংলা ভাষাটা শিখে যায় কিন্তু অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা এসে আর কি করবে ওরা এসে আবার চলে যায়।
হলগুলোতে তারা কোনো ফ্যাসিলিটি পায় না। অসুবিধায় পরলে কোনো সমাধান পায় না। যেটুকু পায় হলে আমার কিছু বন্ধু জব করে, আমার কিছু কলিগ, হাউস টিউটর বা আরেফিন স্যারকে আমি যখন কল দেই তখনই তারা কিছুটা করে। আমারতো পারসোনালি কোনো ফান্ড নাই যখন আমি প্রশাসনের কাছে নোট দেই তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এদিকে একটু নজর দেয়। তারপর আবার বলে এগুলোতো হল প্রশাসনেই করে দিবে। অন্যান্য ভার্সিটিতে যারা পড়ছে তারা এক বছর আগে বের হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখানে তারা বের হতে পারছেন না। যেমন সিএসইতে সেশনজট আছে ফার্মেসিতে মাত্র দুইজন শিক্ষক আছে। শিক্ষার্থীরা আমার কাছে প্রায়ই আসে তখন আমি তাদের বলি তোমরা কিছু স্টুডেন্ট রিকমেন্ড কর এখানে। তখন তারা বলে স্যার আপনারা আগে এই সমস্যাগুলো মিটান আমরা স্টুডেন্ট আনছি।
গত সেশনে স্টুডেন্ট ভর্তি না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২১-২২ সেশন ভর্তি হতে না হতেই তার পরের সেশন চলে আসলো, আমরা যখন সার্কুলার দিয়েছি তখন স্টুডেন্টরা এই সেশনটি ম্যাচ করাতে পারেনি। তখন যারা পারেনি তারা হয়তো এইবার করতে পারবে।
তিনি বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ৮০% পর্যন্ত স্কলারশিপ দেয় শিক্ষার্থীদেরকে, কিন্তু আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্টো তাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। তাহলে কি কারণে আসবে শিক্ষার্থীরা। তাও আসতো যদি আমাদের একাডেমিক সমস্যাগুলো না থাকতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীগুলো মূলত কৃষিতে এবং মেডিক্যালগুলোতে আসে। কিছু জায়গায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও আসে। ঢাবিতেও এখন একেবারে নেই বললেই চলে। তবে মূল পরিস্থিতিটা যে কি আমাদের ডিরেক্টর আছে তিনি ভালো জানেন। আমি মনে করি স্কলারশিপ না পাওয়া একটা বড় কারণ। অন্য দেশে পার্টটাইম কাজের সুযোগ আছে যা এই দেশে নেই। ভাষাগত একটা সমস্যা আছে। সেইক্ষেত্রে টিচাররা যদি আলাদা একটা নজর দেয় তাদের প্রতি তবে এইটা থাকতো না। যেসব বিভাগে জট আছে বিদেশিদের কথা চিন্তা করে হলেও বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, যার এই সেলের দায়িত্ব তিনি আমাকে এই সীমাবদ্ধতাগুলো জানান না। আজকেও তার সাথে কথা হয়েছে ফরেনদের সমস্যাগুলো আমাকে জানাতে হবে তো। সকল তত্ত্বাবধায়ন ভিসির পক্ষে করা সম্ভব হয় না। যে যেটার দায়িত্বে আছেন তাকে সব কাজ সামলে সেই দিকটাও দেখতে হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available