এন এম শাহরিয়ার: নদীবিধৌত বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত প্রায় সকল শ্রেণির মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানোর অন্যতম উৎস মাছ। অন্তত আড়াইশো প্রজাতির মাছের উপস্থিতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদই বটে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের প্রচলন। পাঙ্গাস এবং রুই দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে এ চাষ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য প্রজাতিতেও। বর্তমানে বাংলাদেশে রুই, পাঙ্গাসের বাইরে কই, মাগুর, শিং, পাবদা, গুলশা, তেলাপিয়া, কাতলা, মৃগেল, গ্রাসকার্প, বিগহেড কার্পসহ আরও অনেক প্রজাতির মাছের বাণিজ্যিক চাষ ও উৎপাদন হচ্ছে।
ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পূর্বের ১.৯০ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে মৎস্য উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২.১৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা প্রতি হেক্টরে বেড়েছে ৪.৮৫ মেট্রিক টন থেকে ৫.২৮ মেট্রিক টন। এই বিপুল সম্ভাবনাময় খাতকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে সরকারি বিভিন্ন নীতিমালা থাকলেও সেগুলো অনেকাংশেই সেকেলে। উদাহরণস্বরূপ আমাদের জাতীয় মৎস্য নীতি সর্বশেষ হালনাগাদ হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে। সেখান থেকে দেশের মৎস্যখাত, বিশেষত দেশের বাণিজ্যিক মৎস্য উৎপাদন খাত আজ এগিয়েছে কয়েক ধাপ, কিন্তু নীতিমালার অভাবে এবং অন্যান্য কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এই খাতের সাথে জড়িতদের পড়তে হচ্ছে নানান অসুবিধায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে প্রায় বিশটির বেশি ক্লাস্টারে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য উৎপাদন হচ্ছে এবং এই বিস্তির্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন উপায়ে চাষ করা হচ্ছে। এ খাতের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতের অন্যতম বাধা হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, খরা এবং অতি তাপমাত্রার কিংবা অতি নিম্ন তাপমাত্রা ইত্যাদির কারণে প্রতিবছর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।
ইনোভিশনের গবেষণায় দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের আকস্মিক বন্যায় ময়মনসিংহ জেলায় প্রায় আশি শতাংশ উৎপাদনই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। একই চিত্র পাওয়া গিয়েছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। একই সাথে তীব্র তাপদাহে নাটোর এবং রাজশাহী অঞ্চলের মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ব্যাপক হারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাবের উপর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বন্যার কারণে ৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ২০২০ সালে বন্যার ফলে ২৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক ক্ষতি এবং ২১ হাজার ১শ’ ৫৬ মেট্রিক টন মৎস্য খাতে উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। একই সময়কালে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি অনুমান করা হয়েছিল ২৮.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; উৎপাদনক্ষতি অনুমান করা হয়েছিল ১২ হাজার ৪শ’ ৮০ মেট্রিক টন। এই একই সময়ে চিংড়ি উৎপাদনে, জলবায়ু দুর্যোগের কারণে ৮.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে; উৎপাদনক্ষতি ছিল তিন হাজার টন।
এই ব্যাপক ক্ষতি সামাল দিয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করা অথবা ক্ষতিকে পুষিয়ে নিয়ে সামনের দিকে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেকাংশেই প্রান্তিক খামারী এবং কিছুক্ষেত্রে মাঝারী খামারিদের জন্যে প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে সাধারণত বিভিন্ন ব্যবসার ঝুঁকিকে কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য ইন্স্যুরেন্সের প্রচলন রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান বাজার খুবই সীমিত। ব্যক্তি এবং কর্পোরেট পর্যায় ব্যতিত ব্যবসাখাতে, বিশেষত কৃষিখাতে ইন্স্যুরেন্স অনেকটা নতুন ধারণা এ দেশের প্রেক্ষাপটে।
ইনোভিশনের গবেষণায় দেখা গেছে, মৎস্যখাতের সাথে সরাসরি জড়িতদের একটা বড় অংশই মনে করেন যে, এ খাতের ঝুঁকিগুলোকে প্রশমিত করার জন্য ইন্স্যুরেন্সের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণার সম্মিলিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মৎস্যখাতের ইন্স্যুরেন্সের বাজারের আকার প্রায় ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ব্যপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের বাজারে এ খাতকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সঠিক নীতিমালার অভাব, ভোক্তাপর্যায়ে ইন্স্যুরেন্সের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিদের নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণে দেশের কৃষিখাতে বিশেষত মৎস্যখাতে এরকম ইন্স্যুরেন্সের এখনো প্রচলন নেই।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এ খাতে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ ইন্স্যুরেন্সখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যথাযথ উদ্যোগ এবং মৎস্যখাতের সাথে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাদের সঠিক নীতিমালা এবং কর্মপদ্ধতি প্রণয়নের মাধ্যমে এ অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব। একজন উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার মতে, আগামী বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৎস্যচাষিদের এরকম আকস্মিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়বে এবং সে সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানির ওপরে নির্ভর করতে হবে। এই অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আগেই যদি কৃষককে বাঁচানোর জন্য এরকম ইন্স্যুরেন্সকে জনপ্রিয় করে তোলা না যায় তবে দেশের মৎস্যখাত হুমকির মুখে পড়বে।
লেখক: এসোসিয়েট, ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন, ইনোভিশন কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেড।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available