মো. কামাল উদ্দিন: শিক্ষা ও নৈতিকতা একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসলামি নৈতিকতার ব্যাপক শিক্ষা ও চর্চাই এ দেশের মানুষকে বর্তমান নানামুখী অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান সমাজের জন্য নৈতিক শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি নীতির অনুশীলন, নীতির চর্চা। কাজেই নৈতিকতা হল এমন এক বিধান যার আলোকে মানুষ তার বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারে। নৈতিকতা হল ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। আর এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা। সততা, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র- এ সবকিছুর সমন্বয় হল নৈতিকতা। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চালচলন, ওঠাবসা, খাওয়া-দাওয়া, আচারব্যবহার, লেনদেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি বলে।আর ধর্মই এই নৈতিকতার শিক্ষা দেয়।
নীতিহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, যাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না, কান আছে কিন্তু তা দিয়ে শোনে না। এরা হল চতুষ্পদ জন্তুর মতো। বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট (সূরা আরাফ-১৭৯)।
নৈতিকতা ও আদর্শিক শিক্ষার অভাবই সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সামাজিক অবক্ষয়জনিত কারণে সৃষ্ট ও বিস্তৃত সামাজিক অপরাধ বেড়েছে বহু গুণ। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে মানুষের হৃদয়বৃত্তিতে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। পরিণতিতে সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে বেড়ে চলছে আত্মহত্যা, হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা।
মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোয় ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। আর এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমময় সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। ক্ষেত্রবিশেষ বলি হচ্ছে নাড়িছেঁড়া ধনসম্পত্তির মতো সন্তানসন্ততি। ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুখ-শান্তি।
কিছু পশুতুল্য এবং সম্পদশালী মানুষ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন লোকদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এসব কুরুচিশীল মানুষ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে সমাজ। নিরীহ ভদ্রলোকরা সমাজে পদে পদে হচ্ছে কোণঠাসা ও নিগৃহীত। সমাজে দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ অবক্ষয়। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ ও উত্তরণ নৈতিক অধঃপতনের বহুবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল।-মানুষের ভিতরকার অনুশীলিত কৃষ্টির বাহ্যিক পরিশীলিত রূপকে সংস্কৃতি বলা হয়। এটা তওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের আলোকে শারঈ নির্দেশনায় গড়ে উঠলে সেটাই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতি। এর বাইরে যা কিছু আছে সবই নষ্ট ও অপসংস্কৃতি। বর্তমানে সমাজের মানুষের মাঝে নষ্ট সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট, যা তাদেরকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
চিত্তবিনোদনের নামে বানানো সিনেমাগুলো অশ্লীল ছবি, নৃত্য, মারামারি ও আজগুবি কাহিনীতে ভরপুর। টিভির অশ্লীল অনুষ্ঠানগুলি একদিকে যেমন শিশু-কিশোর ও যুবকদের চরিত্র বিনষ্ট করছে, অন্যদিকে তেমনি তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে ধ্বংস করছে। সমাজ থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। তারা সিনেমার বানোয়াট কাহিনি নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করে। এতে করে তাদের আকিদা নষ্ট হয় এবং লজ্জাশীলতা দূর হয়ে যায়। অন্যদিকে মেধা ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট হয়ে যায়।
পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য ইলেকট্রিক মিডিয়ার সাহায্যে চালাচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এ আগ্রাসনকে শক্তিশালী করার জন্য তারা এ সবের উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে এর বেপরোয়া ব্যবহার করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে এদেরই একজন অন্যতম সমাজ বিজ্ঞানী Michael Kunezik বলেন, Cultural imperialism through communication is a vital Process for Securing and maintaining economic domination and political hegemony over others (Television is the Third World) অর্থাৎ ‘অর্থনৈতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন ও তা বহাল রাখার জন্য যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া’। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিশ এন্টিনার সাহায্যে পাশ্চাত্যের ধর্ম বিমুখ আল্লাহদ্রোহী ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগবাদী জীবনের সকল অনুসঙ্গই আজ মুসলমানদের অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছে।
বর্তমানে যুবক ও যুবতীরা প্রগতির দোহাই দিয়ে বিধর্মীদের অনুকরণে তৈরীকৃত পোশাক পরে নগ্ন-অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুবকেরা লম্বা চুল রেখে হাতে বিভিন্ন ধাতুর বালা ও সোনার চেইন পরে, পাঞ্জাবী শার্টের বোতাম খুলে, হাতে সিগারেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার মেয়েরা জিন্সের স্কিন টাইট প্যান্ট-শার্ট পরছে। কেউ কেউ মশারির মত পাতলা পোশাক পরে চলাফেরা করছে। এতে তাদের দেহের উঁচু-নিচু স্থান যুবকদের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আবার অনেক যুবতী মেয়ে শর্টকাট পোশাক পরে সাইকেল, হোন্ডা চালাচ্ছে। এসব বেহায়াপনা যুবকদেরকে পথভ্রষ্ট করছে।
বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তামাকজাত পণ্য ও মাদকদ্রব্য। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের তরুণ-তরুণীদের জীবন; ধসিয়ে দিচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল।
কথায় বলে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ব্যক্তি জীবনে বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীর প্রভাব সমাজের মানুষের নৈতিক উন্নতি ও অবনতির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বন্ধু ও সঙ্গীদের খপ্পরে পড়ে সহজ-সরল বন্ধুটি প্রথমে একটু একটু করে ধূমপান ও মদের স্বাদ আস্বাদন করতে করতে অবশেষে বদ্ধ মাতালে পরিণত হয়। বন্ধু-বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে সে যাত্রাগান, টিভি, সিনেমা দেখা, আড্ডা দেওয়া এমনকি যেনা-ব্যভিচারেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাই সৎ বন্ধুদের আর সত্যবাদী সাথীদের সাথে থাকার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُواْ مَعَ الصَّادِقِيْنَ ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)।
সমাজের নৈতিক অধঃপতনের জন্য দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক চরিত্র গঠন, ইমান, আকিদা, আমল সংশোধন এবং আখিরাত, মৃত্যু, কবর ও জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে সতর্ক করার যথাযথ পদক্ষেপ নেই। আবার এ শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে ধর্মহীন। অথচ সমাজের মানুষের নৈতিক অধঃপতনের প্রধানতম কারণ হল সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার যথাযথ অভাব। এ বিষয়ে Stanly Hall বলেন, If you teach your children three Rs (Reading, Writing and Arithmetics) and leave the fourth ‘R’ (Religion) you will get fifth ‘R’ Rascale. ‘যদি আপনি আপনার সন্তানকে তিনটি ‘R’ শিক্ষা দেন, (পড়া, লিখা, অঙ্ক) এবং চতুর্থ ‘R’ টি (ধর্ম) বাদ দেন তাহলে আপনি পাবেন পঞ্চম ‘R’ (বদমাশ)।
অর্থনৈতিক দুর্দশা নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত করে। সময়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে জীবনে হতাশা জাগে। অনেক যুবক দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি লাভ করেও উপযুক্ত কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, দলনীতি ইত্যাদি কারণে ন্যায় পথে জীবিকা অর্জন অনেকটা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আবার দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সম্পদের অসম বণ্টন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্য, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদির ফলে সমাজের এক শ্রেণীর লোক অর্থ শোষণ করে জোঁকের মত ফুলে উঠছে। আরেক শ্রেণীর মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।ফলে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সামাজিক মূল্যবোধের এ অবক্ষয় রোধে আমাদের অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সম্মান বা মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করা সম্ভব হবে না। তাই আশু করণীয় হিসেবে নিুবর্ণিত কর্মপন্থা বিবেচনা করা যেতে পারে- নৈতিকতা বৃদ্ধিকল্পে ইসলাম ধর্মের জন্য ইসলাম, হিন্দুদের জন্য হিন্দু ধর্ম, খ্রিষ্টানের জন্য খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধদের জন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ও নৈতিক শিক্ষার চর্চা করা। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা ও উচ্চ নৈতিক মানের জন্য পুরস্কৃত করা। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উন্মুক্ত অপসংস্কৃতি বন্ধ করা।
শিশুদের হাতে মোবাইলে ইন্টারনেট প্রযুক্তি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় আইনি এবং সামাজিক ব্যবস্থা নেয়া। বিসিএসসহ সব নিয়োগ পরীক্ষায় গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে উন্নত ছাত্রজীবনের চারিত্রিক ইতিহাস মূল্যায়ন করা। সব অফিস-আদালতে নৈতিকতা ও সততার জন্য পদোন্নতি ও পুরস্কারের প্রথা চালু করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা করা এবং বিশেষ ট্রাইবুনালে সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রকৃত দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করা। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে দেশের সৎ মানুষদের দায়িত্ব দেয়া।
দেশে বহু আইন আছে; কিন্তু তার প্রয়োগের জন্য সর্বস্তরের আন্তরিকতা বিশেষভাবে দরকার। সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হবে নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষায় আলোকিত এক পরিচ্ছন্ন সমাজ ও দেশ।সুতরাং শিক্ষা ও নৈতিকতা এ দুটির সমন্বয় হলে একজন মানুষ সৎ, চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে।আল্লাহ আআলা আমাদেরকে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হওয়ার তাওফিকদান করুন। (আমিন)
লেখক: মো. কামাল উদ্দিন, লেকচারার, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা, বাংলাদেশ।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available