নিজামুল হক বিপুল: সংলাপ নিয়ে আবারও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু একটি চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সেই চিঠি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন। ইতোমধ্যে তিনি সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পৌঁছে দেন। এরপর তিনি বিএনপির কাছেও আরেকটি চিঠি পৌঁছে দেন। যেটি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন বিএনপির সিনিযর যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে ডোনাল্ড লু’র চিঠিটি এখনও পৌঁছেনি। চিঠিতে ডোনাল্ড লু শর্তহীনভাবে সংলাপে বসার জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। সংবিধান অনুযায়ি আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ইতোমধ্যে নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রেওয়াজ অনুযায়ি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম গত সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখাও করেছেন। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনও নির্বাচন কমিশনকে তাদের কাজ করার সম্মতি দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন চলতি সপ্তাহেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা।
কিন্তু এরমধ্যে হঠাৎ করে সোমবার বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘সংলাপের ঘি’ ঢেলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তার এই তৎপরতায় নানান প্রশ্ন উঠেছে দেশের রাজনৈতিক মহলে। রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন যেখানে তফসিল ঘোষণার সকল প্রস্তুতি শেষ করেছে, সেখানে হঠাৎ করে কেন শর্তহীন সংলাপের জন্য তৎপর হলেন ডোনাল্ড লু? এর নেপথ্যে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা- সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ,সুষ্ঠু, ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে গত মে মাসে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি প্রণয়ন করে। যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যারা অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে তাদের ক্ষেত্রে মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হবে। গত মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষনার পর সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এসে সেটি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এরমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সঙ্গেও বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এসব বৈঠকে সংলাপ নিয়ে কথা বললেও বিষয়টি বেশি দূর এগোয়নি।
বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের শর্ত সাপেক্ষে সংলাপে বসার কথা বললেও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বার বার বলে আসছেন, নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ি। এখানের সংলাপের কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না আওয়ামী লীগ। তবে দলটির একাধিক নেতা এ কথাও বলেছেন, সংলাপ হতে পারে, তবে সেটা হবে কিভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়। কোনো শর্তসাপেক্ষে সংলাপে বসার কথা তারা উড়িয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ গতমাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাসেলস সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, কিসের সংলাপ, কার সঙ্গে সংলাপ? তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি ট্রাম্পের সঙ্গে সংলাপে বসেন তাহলে আমরাও সংলাপ করবো।
দেশের রাজনীতিতে সংলাপ যখন বহু দূরে- ঠিক তখন প্রতিবেশি ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে নিয়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পর্যায়ে (২+২) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠক শেষে গত শুক্রবার (১০ নভেম্বর) ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত তার অবস্থান পরিস্কার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বৈঠকের বর্ধিত আলোচনায় আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু, দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তৃতীয় দেশের নীতি নিয়ে মন্তব্য করা আমাদের জায়গা নয়। আমি মনে করি, যখন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয় আসে, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিনয় কোয়াত্রা বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসাবে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানাই এবং স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল জাতি গড়ার যে রূপকল্প তারা ঠিক করেছে, সেক্ষেত্রে ভারত সমর্থন অব্যাহত রাখবে।’
দিল্লীতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র টু প্লাস টু বৈঠকের তিন দিন পর এবং বাংলাদেশে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে সোমবার হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র শর্তহীন সংলাপের চিঠি নিয়ে রহস্যের তৈরি হয়েছে।
যদিও সোমবার এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার আগের মতই বলেছেন, তার দেশ বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা জনগণের মাধ্যমেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে প্রধান তিন রাজনৈতিক দলকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লুর চিঠির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপ যে একটা অর্থহীন বিষয সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রক্রিয়া শুধুই সময় অপচয়ের একটা মাধ্যম মাত্র। এর আগেও বাংলাদেশে বহুবার সংলাপ বসেছিল ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। যা কোনো ফল বয়ে আনেনি। সর্বশেষ ২০০৬ সালে যখন তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তখনও তৎকালীন সরকারি দল বিএনপি ও সংসদের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে লাগাতার সংলাপ হয়েছিল। বিএনপি পক্ষে দলটির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের মধ্যে দফায় দফায় সংলাপ হয়েছিল। এখানেও বিদেশী মধ্যস্থতা ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সংলাপ ব্যর্থ হয় এবং সেনা সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আবির্ভাব ঘটে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপ যে একটি অকার্যকর ও ভোঁতা পদ্ধতি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এবারও ঠিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহুর্তে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ডোনাল্ড লু তিনটি রাজনৈতিক দলকে যে চিঠি দিয়েছেন, সেটি যে খুব বেশি আশার সঞ্চার জাগাবে তার কোনো আলামত অন্তত দেখা যাচ্ছে না। কারণ সরকার বরাবরই বলে আসছে সংবিধান অনুযায়িই যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অপরদিকে বিএনপি ও তার মিত্রদের দাবি, সরকারকে পদ্যতাগ করতে হবে। এই অবস্থায় ডোনাল্ড লু’র শর্তহীন সংলাপের চিঠি শুধুই যে সময়ক্ষেপনের একটা অস্ত্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন কবে নাগাদ তফসিল ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে যতদূর জানা গেছে তাতে ধারণা করা যাচ্ছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল দু’এক দিনের মধ্যেই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তার ভাষণের পর পরই কমিশন তফসিল ঘোষণা করতে পারে। আর তফসিল ঘোষণা হলেই স্পষ্ট হবে সংলাপের ভবিষ্যত।
লেখক: সাংবাদিক।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available