মো. কামাল উদ্দিন: পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্ভেজাল সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। সব নিয়ম অনিয়ম, বিশ্বাস, নির্ভরতা আর বাঁধভাঙা সম্পর্কের মিলনস্থল হলো বন্ধুত্ব।মানুষ প্রকৃত বন্ধু চিনতে পারে যখন সে কোন বিপদের মুখে পড়ে। বিপদে না পড়লে আসল বন্ধু চেনা যায় না। বিপদের মুখে যখন মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তার অন্য বন্ধুদের সাহায্য দরকার হয়। কিন্তু অতি চালাকি বন্ধুরা সেই সময় নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে। অপরকে সাহায্য করার মন মানসিকতা তখন তার থাকে না । বন্ধুর দুঃখ কষ্টকে সে পাত্তাই দিতে চাই না। এটাই হল ভণ্ড বন্ধুর নমুনা। কিন্তু যারা প্রকৃত বন্ধু তারা কখনই বন্ধুদের ছেড়ে যায় না । কষ্টের সময় তারা বন্ধুকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত থাকে।
কিন্তু সুসময়ের বন্ধুরা আবার ফিরে আসে যখন সে আবার সুসময়ে আসে দাঁড়ায় । প্রকৃত বুদ্ধিমানরাই তখন তাকে চিনতে পারে এবং দূরে ঠেলে দেই । কারণ সে বুঝতে পারে দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। একজন ভালো বন্ধু পাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কোনো ধরনের স্বার্থ কিংবা প্রাপ্তির চিন্তা মাথায় না রাখা। স্বার্থের প্রয়োজনে করা বন্ধুত্ব আপনাকে একটা সময়ে লাভবান করলেও চূড়ান্ত বিচারে আপনাকে করে তুলতে পারে নিঃসঙ্গ। তাই কোনো ধরনের প্রাপ্তির চিন্তা থেকে নয়, বরং নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসাগুলোকে ভাগাভাগি করে নেয়াই হোক বন্ধুত্বের প্রথম চাওয়া।
বন্ধুত্বকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের খুব কাছের একটি অংশ ধরা হয়। দার্শনিক এমারসন বলেছেন, একজন বন্ধু হচ্ছে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় মাস্টারপিস। বন্ধুত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্যে কবি বা দার্শনিক হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আপনার আনন্দে এবং দুঃখে আপনার পাশে কেউ না থাকলে আনন্দ যেমন বহুলাংশে মাটি হয়ে যায়, তেমনি দুঃখও সহজে হালকা হয় না। মানুষ যখন বেদনা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তখন বন্ধুর কাছ থেকে সে প্রথম সান্ত্বনা পায়, আর যখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে তখন এ আনন্দের খবর সে প্রথম বন্ধুকেই জানায়।
বন্ধু হলো সর্বোৎকৃষ্ট আয়না। এই আয়নাতে প্রতি মুহূর্তে সে নিজেকে দেখে। শুধু বাহ্যিক অবয়বকে নয়, বরং ভেতরটাকেও। বন্ধুত্ব হওয়া চাই হাত আর চোখের সম্পর্কের মতো। হাতে ব্যথা লাগলে চোখে পানি আসে। আর চোখে যদি পানি আসে, তবে হাত এগিয়ে যায় তা মুছে দিতে। বন্ধুর কোন রং হয় না, অনেকটা পানির মতন রং বর্ণহীন। বন্ধুত্ব হচ্ছে সেই সম্পর্ক যেখানে একজন আরেকজনকে নিস্বার্থভাবে সাহায্য করে, সুসময়ে, দুঃসময়ে, সবসময় তার পাশে থাকে। একজন খাঁটি বন্ধু কখনও হিংসার বশবর্তী হয়ে তার বন্ধুর অমঙ্গল চাইতে বা করতে পারেনা, যদি তা করে, তাহলে সেটি বন্ধুত্ব না।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম ভালো বন্ধু সম্পর্কে বলেন- “একটি বই একশটি বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান।”
একজন প্রকৃত বন্ধু চেনা যায় বিপদের সময়। বন্ধুর বিপদে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই পাশে দাঁড়ানো হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয়। প্রয়োজনে সময়ে- অসময়ে বন্ধুর বিপদে তাকে সাহায্য করা। যে বন্ধু কোনো স্বার্থ ছাড়াই বিপদের দিনে আপনাকে সাহস যোগায় সেই মানুষটি অবশ্যই আপনার প্রকৃত বন্ধুদের মধ্যে একজন।
বন্ধুত্বে বিশ্বাস রক্ষা করা খুবই জরুরি। তৃতীয় কোনো পক্ষের কথার সূত্র ধরে বন্ধুত্বের বিশ্বাসভঙ্গ কখনোই কাম্য নয়। যে বন্ধু আপনার কোনো ব্যক্তিগত বিষয় অন্য মানুষকে বলে বেড়াবে সে আর যাই হোক আপনার প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। বন্ধুর ইচ্ছাকে সবসময় সম্মান জানানো উচিত। যদি তা পছন্দ না হয়, তবে সরাসরি বলুন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা অবশ্যই জরুরি। সমালোচনা করুন, তবে কটূক্তি নয়। সমালোচনার ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়ায় খুবই প্রয়োজন। আপনার কোনো ভুল হলে প্রকৃত বন্ধু আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে না, আপনাকে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করবে। বন্ধুর প্রতি বিনয়ী হওয়াই বন্ধুত্বের প্রধান হাতিয়ার।
যে কোনো বিষয় নিয়ে আপনি তার ওপর রাগ ঝাড়তে পারেন, বকাবকি করতে পারেন। এতে সম্পর্কে চরম টানাপোড়েনও দেখা দিতে পারে। কিন্তু যখন বুঝবেন ভুলটা আসলে আপনারই, তখন? এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো বন্ধুটির কাছে আপনার একটাই প্রত্যাশা থাকতে পারে, তাহলে আপনাকে ক্ষমা করে দেওয়ার ব্যাপারে সে ২য় বার ভাববে না।
সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সাহস ও সমর্থন দেবে। জীবনে চলার পথে আপনি লক্ষ্যচ্যুত হলে বা মনোযোগ হারিয়ে ফেললে, সে-ই আপনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেবে। তারপরও যদি ব্যর্থ হন, সেটিকে পাত্তা না দিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরুর প্রেরণা যোগাবে।
সে-ই আপনার প্রকৃত বন্ধু, ভালোবাসার লাবণ্য বজায় রেখেও যে আপনার ভিতরের আবর্জনাকে চিহ্নিত করতে পারে। এটাই ফ্রেন্ডশিপ! এটাই হলো বন্ধুত্বের মূল কথা।হজরত আলি (রা) বলেছেন, ‘নির্বোধের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো। কারণ সে উপকার করতে চাইলেও তার দ্বারা তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে।’ হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ :) বলেছেন, ‘যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। আর তা হলো- ‘বুদ্ধিমত্তা, সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া, পাপাচারী না হওয়া, বেদআতি না হওয়া এবং দুনিয়াসক্ত না হওয়া।’ রাসুল (স.) বন্ধুত্বের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সৎ সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে- আতর বিক্রেতা এবং কামারের হাপরের ন্যায়। আতর ওয়ালা তোমাকে নিরাশ করবে না; হয় তুমি তার কাছ থেকে ক্রয় করবে কিংবা তার কাছে সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাপর, হয় তোমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে, নচেৎ তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে আর না হলে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি)
নবি (স.) পৃথিবীতে বন্ধুত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.) ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু। আল্লাহর রাসুল (স.) ও হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.) এর বন্ধুত্ব আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়।
বন্ধু সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কি বলেছেন দেখা যাক- বন্ধু নির্বাচনে যে গুণটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তাওবা-১১৯)
একজন ভালো বন্ধু শুধু বন্ধুর ইহকালের কল্যাণ কামনা করে তা নয়, বরং ইহকাল ও পরকাল উভয় কালের কল্যাণ কামনাকামী। আর পরকালের কল্যাণে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বন্ধু নির্বাচনে একজন মানুষ হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ ইমানদার। যা প্রিয়নবি (স.) ঘোষণা করেছেন ‘যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাউকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাউকে ঘৃণা করে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে দান করে কিংবা দান করা থেকে বিরত থাকে, সে তার ইমানকে পূর্ণ করেছে।’ (আবু দাউদ)
আপনি যদি বন্ধুকে যাচাই করতে চান এবং দেখতে চান ওই ব্যক্তি সত্যিই প্রকৃত বন্ধু কিনা, তাহলে খেয়াল রাখুন আপনার সুসময় ও দুঃসময়ে বন্ধুত্বের মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে কিনা। খেয়াল করুন রেগে গেলে খারাপ কথা বলে কিনা, অপমানজনক বক্তব্য দেয় কিনা, অন্যের দুঃসময়ে সাহায্য করে কিনা। কেউ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে তাকে ছেড়ে চলে যায় কিনা। হজরত আলী (আ.)-ও বন্ধুকে দুঃসময়ে পরীক্ষা করতে বলেছেন। এছাড়া সফরে গেলেও বন্ধুকে চেনা যায়। সফরে গেলে মানুষকে সুখকর ও কঠিন দুই পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হতে হয়। সফরে নিঃস্বার্থপরতা ও স্বার্থপরতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। মনে রাখতে হবে ভালো বন্ধু কখনোই মিথ্যা বলে না এবং কখনোই প্রতারণা করে না। প্রতারণা ও মিথ্যাচারিতা খুব দ্রুত বন্ধুত্বের বন্ধনকে নষ্ট করে দেয়।
যিনি সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের বন্ধু খুঁজছেন তাকেও সর্বোত্তম বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজের গুণের আলোয় তাকে আলোকিত করার চেষ্টা করতে হবে। বন্ধুকে সংশোধন করতে নিজেকে আন্তরিক ও আস্থাপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। বন্ধুকে অত্যন্ত সুন্দর ও ভদ্র ভাবে তার ঘাটতিগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে হবে এবং তাকে বুঝাতে হবে আপনি তার মঙ্গল চান, আপনি তার ভালোর জন্যই পরামর্শ দিচ্ছেন। ভালো বন্ধুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বন্ধুর দোষ-ত্রুটি অন্যের সামনে ঢেকে রেখে তাকে সংশোধ করার চেষ্টা চালানো। আসলে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে সত্যিকারের বন্ধুর বিকল্প নাই। সত্যিকারের বন্ধুই মানুষের গোটা জীবনকে উপভোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছেশক্তি বাড়িয়ে দেয় একজন ভালো বন্ধু। ভালো বন্ধু আস্থার জায়গা হিসেবে গণ্য হয়।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে পারস্পরিক সুসম্পর্ক তৈরি করে যেন একে অপরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করার তাওফিক দেন।আর সুসময়ের ভণ্ডদের থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন- (আমিন)
(লেখক. মো. কামাল উদ্দিন, প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা)
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available