খোকসা (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি: গ্রীষ্মের সূর্যতাপ ও খড়ায় নাস্তানাবুদ দেশের মানুষ। তীব্র তাপদাহে নেই এক বিন্দু ফুসরত। মাতৃকোড়ের শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ, চাকুরে কিংবা দিনমজুর ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল সকলেই। মানুষের ক্লেশ বিড়ম্বনা মুক্তিতে প্রযুক্তির নিরত্নন সকল চেষ্টাই যখন প্রকৃতির কাছে অসহায় তখন এক চিমটি শীতলতা পেতে তাল পাখার জুরি মেলা ভাড়।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ৪নং সদকী ইউনিয়নের মটমালিয়াট গ্রামটি এখন পাখাগ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামের প্রায় দেড়শতাধিক পরিবার হাতপাখা তৈরির সাথে যুক্ত। রবিবার মটমালিয়াট ঘুরে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সংসারের কাজের পাশাপাশি পুরুষের সাথে তাল পাতা দিয়ে হাত পাখা তৈরিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে গ্রামের অনেক নারী। গরম বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে কাজের চাপ বাড়ে' হাতপাখা' গ্রামের মানুষের। এ সময় তাল পাতা দিয়ে বানানো পাখার চাহিদা বেড়ে যায় বহু গুণ। তাল পাতার পাখা বানিয়ে স্বচ্ছলতা ও ফিরেছে অনেক সংসারে।
হালিমা বেগম নামে ৩৫ বছর বয়সী পাখা তৈরীর এক কারিগর জানান, পাতা সংগ্রহ, ধোয়া, শুকানো এবং পরিষ্কারের কাজ করে পুরুষরা। আর পাখা আকৃতির মত পাতাগুলো কেটে রং দেয়া, বাঁশের কাঠি যুক্ত করা, সুতা দিয়ে বাঁধায়ের পর পাখার পূর্ণ রুপ দানে নারীরা সিদ্ধ হস্ত।
তিনি আরও জানান, একজন নারী প্রতিদিন ৬৫ থেকে ৭৫ পিস পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারেন। ৭৫টি হাতপাখা সুতা দিয়ে সেলাই ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের বিনিময়ে পেয়ে থাকেন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা।
উপজেলার তালপাখা তৈরীর কারিগর রহিম মালিথা, সাত্তার শেখ, জুরান শেখ, উজ্জল হোসেনসহ একাধিক হস্তশিল্পী জানান, জেলা ও জেলার বাইরে থেকে পাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল তালের পাতা পিচ প্রতি কেনা হয় ১০-১৫ টাকা দরে। প্রতি পিচ পাতায় ৮-১০টি পাখা তৈরি করা যায়। প্রতিটি বাঁশ কেনা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। এক একটি বাঁশে পাখা হয় শতাধিক। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা। তৈরিকৃত পাখাগুলো মান ভেদে পাইকারী বিক্রয় হয় ১৮ থেকে ২৫ টাকায়। আর হাত বদলে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত গিয়ে সেটির মূল্য দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা । এখানকার তৈরিকৃত পাখাগুলো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও বিক্রি করা হয়। তবে তাপমাত্রার সাথে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে পাখার চাহিদার।
হাত পাখার কারিগর উজ্জল হোসেন বলেন, মৌসুমের শুরুতে ১৩০ থেকে ১৪০টি পাখা তৈরি হলেও গরম বাড়ার সাথে সাথে ২০০ থেকে ২৫০টি পাখা তৈরি করতে হচ্ছে। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হাত পাখার প্রধান উপকরণ 'তালপাতার' সংকটের কথাও জানান তিনি ।
আজমত আলী নামের আরেকজন জানান, চাহিদা বেশি থাকলেও হাতপাখা তৈরি উপকরণ যেমন তালগাছের পাতা, বাঁশ, সুতা, ভিন্ন ভিন্ন রং, মোম ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। সেই তুলনায় লাভ কম হওয়ায় পরিবার নিয়ে আর্থিক কষ্টে ভুগতে হয়। আর্থিক সংকট নিরসনে সরকারি সহায়তার কথাও বলেন কুঠির শিল্পের এই কারিগর।
এদিকে পাখা গ্রাম থেকে সংগৃহীত পাখা, আশেপাশের জেলা উপজেলাতে বিক্রয়কারী একাধিক পাইকার জানান, এখানকার তৈরিকৃত পাখার গুণগত মান ভালো থাকায় বাজারে এর কদর রয়েছে। বাজারে চাহিদা থাকার দরুন বিক্রি ও মুনাফা দুটোই সন্তোষজনক বলেও জানান তারা।
এ বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফেরদৌস নাজনীন জানান, তাল পাখা কুমারখালীর একটি ঐতিহ্য। এই পেশায় পুরুষের সাথে সমানভাবে জড়িত মহিলারাও। তাই এটিকে বাঁচিয়ে রাখতে জামানত ছাড়া সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে শিল্প সংশ্লিষ্টদের সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।
কুমারখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত তালপাখাকে বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাথে তুলনা করে বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে উদ্ভূত বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাল পাখা প্রযুক্তির বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা পেশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে একটি অ্যাপস তৈরি করে সেখানে উদ্যোক্তা হিসেবে তালপাখা তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে ইতোমধ্যে যুক্ত করা হয়েছে। কুঠির এই শিল্পকে ত্বরান্মিত করতে প্রশাসনের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available