মাধবদী (নরসিংদী) প্রতিনিধি: গত কয়েকদিন ধরে শাওন আমার কাছে খালি মাফ চাইত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত সে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার পাশে ঘুমাত। এখন তো আর ছেলেকে ছাড়া আমার ঘুম ধরে না বাপু। এখন কী হবে? আমার ছেলেকে মারল কে, আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। কথা শেষ না হতেই রক্ত ভেজা টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বিলাপ করতে থাকে শাওনের মা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে ১৯ জুলাই মাধবদী শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শাওন মিয়া (১৮) নামে এক কিশোর। ছেলে হারিয়ে মা হাসিনা বেগম (৪০) একা হয়ে পড়েছেন। নির্ঘুম রাত কাটছে তার। নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী পৌর শহরের আলগী মনোহরপুর মহল্লার মৃত মজিবুর রহমানের স্ত্রী হাসিনা বেগম।
তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত শাওনের মা হাসিনা বেগম উঠানে বসে আছেন। তার চোখ দুটিতে পানি টলমল করছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ঘরের ভেতরে নিয়ে খাটে বসতে বলেন। পরনের কাপড় দিয়ে তাকে বারবার চোখ মুছতে দেখা যায়। তিনি এই প্রতিবেদককে বলতে শুরু করেন শাওন মিয়ার বেড়ে ওঠার গল্প।
হাসিনা বেগম বলেন, গরিব পরিবারে টানাপোড়েনের মধ্যে বড় হয়েছে তার ছেলে। শাওন সবার ছোট। তাদের অসুস্থ বাবা দুই বছর আগে মারা গেছেন। বড় ছেলে রবিউল ইসলামকে ২ মাস আগে অনেক কষ্ট করে বিদেশে পাঠানো হয়েছে সংসারের হাল ধরতে। অভাবের সংসার। ছেলেদের তেমন লেখাপড়া করাতে পারিনি। শাওন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। মেজো ছেলে মাধবদী বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করে। শাওন সাধারণ একজন মানুষ ছিল, কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। টেক্সটাইল মিলে শাওন নলি ভরার কাজ (সুতা কুলিং) করে সংসার চালানোর খরচ দিত। শাওনকে যে ডাক দিত, সবার কাছেই ছুটে যেত।
তিনি বলেন, ঘটনার দিন শুক্রবার ফজরের নামাজ পড়েছে। খালপাড় মসজিদে জুমার নামাজও আদায় করেছে শাওন। দুপুরে বিয়ের দাওয়াতে না গিয়ে, বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে ছিল। পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বের হয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। বিকেলে শুনি, শাওনকে গুলি করে মাইরা ফেলেছে। পরে অলিউল্লাহ খবর পেয়ে বাড়ি থেকে বাজারে যায়। রাত পৌনে ৮টার দিকে ছেলের মরদেহ নিয়ে আসে বাড়িতে।
শাওনের বড়ভাই মো. অলিউল্লাহ বলেন, ‘বিকেলে বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছিল। তখন রানা নামে একজন মোবাইলে ফোন করে আমাকে বলেন, আপনার ভাই মারা গেছে। মরদেহ নিয়ে যান। তখন বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিট। আমরা নরসিংদী সদর হাসপাতালে যাই। গিয়ে মরদেহ নিয়ে আসি। শাওনের কপালের বাম পাশে একটি গুলির ছিদ্র ছিল। দেখে বোঝা যায়, খুব কাছ থেকে গুলি করে মারা হয়েছে আমার ভাইকে।
তিনি আরও বলেন, ‘মাথা থেকে গুলি বের না করেই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে শাওনের মরদেহ নিয়ে আসা হয়। এ সময় রানা নামের ওই ছেলেও সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাদের এলাকার না, তাকে চিনিও না। ঘটনার দিন রাতেই আলগী মনোহরপুর কবরস্থানে শাওনকে দাফন করা হয়। নিহত শাওনের মা হাসিনা বেগম রক্তমাখা কাপড়গুলোকে আদর করতে করতে বিলাপ করতে থাকেন, আল্লাহ তুমি এর বিচার কর।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available