নিউজ ডেস্ক: ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর প্রায় গোটা পরিবারকে হত্যার দায়ে দণ্ডিত এক ব্যক্তি নির্বিঘ্নে বাস করছেন কানাডার টরোন্টোতে। এ ঘটনায় কানাডার নীরবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে দ্য ফিফথ এস্টেটের অনুসন্ধান। বর্তমানে কানাডায় পলাতক বঙ্গবন্ধুর এই খুনিকে নিয়ে ৪৪ মিনিটের তথ্যচিত্র প্রকাশ করে সিবিসি। কানাডিয়ান টেলিভিশনের অনুসন্ধানী বিভাগ ‘দ্য ফিফথ স্টেট’-এ ‘দ্য অ্যাসাসিন নেক্সট ডোর’ নামের তথ্যচিত্রটি দেখানোর পর সিবিসি তাদের অনলাইনে এটি প্রকাশ করেছে ‘পাশের বাড়ির ঘাতক’ শিরোনামে। সিবিসি’র সেই প্রতিবেদনটি বাংলায় হুবহু দেয়া হলো-
ভোরের আলো ফোটার সময় সত্তরের কোঠার শক্তসামর্থ্য এক ব্যক্তিকে দেখা যায় পশ্চিম টরোন্টোর বাইরের দিকে অবস্থিত একটি ভবনের তৃতীয় তলার ব্যালকনিতে। তিনি সেখানে তার ফুলগাছের পরিচর্যা করছেন। সে সময় তাঁর চেহারা স্পষ্ট বোঝা যায়নি।
এলাকাটিতে গাছপালা ও সাধারণ মানের ঘরবাড়িই বেশি। নিজের ব্যালকনিতে করা বাগান পরিচর্যারত ব্যক্তিটি বোতামওয়ালা নীল শার্ট ও জিন্স পরেছেন। কোমরে শক্ত বেল্ট। পাকা চুল। মাথায় চুলও কম। গত তিন দশকে তাঁর কোনো ছবি পাওয়া যায়নি।
ব্যক্তিটির নাম নূর চৌধুরী। গত ২৭ বছর ধরেই নিজের সহিংস অতীতের কথা লুকিয়ে চুপচাপ বাস করছেন কানাডায়। তাঁর দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নিজ দেশ ছেড়েছেন তিনি। নূর চৌধুরী বাংলাদেশের একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল, ভয়ংকর অপরাধী। বিচার চলাকালে তিনি পলাতক ছিলেন। বিচারে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তাঁর ১০ বছরের শিশুপুত্রসহ ওই পরিবারের ২১ জনকে হত্যার পরিকল্পনার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড থেকে ২০০৬ সালে তাঁর প্রত্যাবাসনের আদেশ (দেশত্যাগের নির্দেশনা) জারি করা হলেও ঠিক কী কারণে এখনো তাঁকে দেশটিতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না কানাডা। দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে যা একটি কাঁটা হয়ে রয়েছে।বিষয়টি নিয়ে স্পষ্টতই হতাশ কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান। অটোয়ার নিজ কার্যালয়ে ফিফথ এস্টেটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এই প্রসঙ্গে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার।’
তিনি এ–ও জানান, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে কানাডার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
‘এই ঘটনায় যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাঁদের বা তাঁদের পরিবারগুলোর ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কানাডা কিছুই করছে না।’
কয়েক মাস দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর বাংলাদেশ হাইকমিশনারের সাক্ষাৎকার নেয় ফিফথ এস্টেট। এর আগে দুই দেশের আদালতের শত শত পৃষ্ঠা নথি পর্যালোচনা করা হয়। কথা বলা হয় বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে। সেই বিশেষ সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়ার পরে এবং সে দেশের পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যপ্রমাণাদি হাতে এলে দেশটির জাতির পিতাকে কারা গুলি করে হত্যা করেছে—তা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনেও যায় ফিফথ এস্টেট। সেখানে একান্তে কথা হয় নিহত রাষ্ট্রপতির কন্যা, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, কানাডা সব সময় মানবাধিকার প্রশ্নে সোচ্চার। তারা কীভাবে এ রকম একটা জঘন্য খুনিকে তাদের দেশে আশ্রয় দেয়? কোথায় তাহলে মানবাধিকার—এটাই আমার প্রশ্ন কানাডার জনগণ ও সরকারের কাছে।’
ফিফথ এস্টেটের অনুসন্ধান এ ঘটনায় কানাডার দীর্ঘ নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রশ্ন তুলেছে কেন তারা বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো উচ্চপর্যায়ে কথা বলতে চায় না—তা নিয়েও।
হলিফ্যাক্সের ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ রব কুরি বলেন, যেভাবে বিষয়টা এখন ঝুলে আছে ,তাতে না নূর চৌধুরীর বিচার হচ্ছে, না বিচার পাচ্ছে বাংলাদেশ বা কানাডার জনগণ। এ ক্ষেত্রে আরও যেসব আইনগত প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি আছে, কূটনৈতিক যেসব পদ্ধতি আছে, সেগুলোর প্রয়োগ দরকার বলে মনে করেন তিনি।
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের বিচার ব্যবস্থা?’
১.
পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেলের ভিড়ে শব্দ আর হর্নের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি কানাডা থেকে যাওয়া অনুসন্ধানী সাংবাদিক দলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তাঁরা কিছু বলতে চান।
কথা বলার সুযোগ পেয়ে তাঁদের একজন বলেন, ‘আমরা নূর চৌধুরীকে ঘৃণা করি।’ আরেকজন বলেন, ‘আমরা জাস্টিন ট্রুডোর কাছে অনুরোধ জানাই, নূর চৌধুরীকে আমাদের দেশে ফেরত পাঠানো হোক এবং আমরা তাঁর বিচার চাই।’
ঢাকার আর সব রাস্তার মতো এটিও ছেয়ে গেছে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের নিহত সদস্যদের স্মরণে লাগানো পোস্টার ও ব্যানারে। সেদিন রাস্তায় দেখা হওয়া দুজনের মতো এ দেশের আরও অনেক মানুষ আছে, যারা সেই হত্যাকাণ্ডের কথা ভোলেনি।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের চারপাশে কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রধান ফটকে বিশাল মেশিনগানসহ সতর্ক প্রহরায় থাকে সৈন্যরা।
এখন পর্যন্ত ১৯ বার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৪ সালে তাঁর জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। সেই ঘটনায় ২৪ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় ৫০০ জন। সে হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেখ হাসিনার, যা নিয়ে এখনো তাঁকে ভুগতে হচ্ছে।
বাঁকানো লোহা ও কাঁটাতারে ঘেরা, লাল ইটের উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন। সবুজ প্রাঙ্গণ তার। আরেক পাশে জলাধার, যেটি তেলাপিয়া মাছে ভর্তি। শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে এখানে বড়শি পেতে বসেন। সময় কাটান।
সরকারি বাসভবনে মার্বেলখচিত মেঝের বিরাট এক বৈঠকখানায় আমাদের সাক্ষাৎকার দেন তিনি। তাঁর পেছনে নিহত পিতার বিশাল একটা ছবি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘কানাডার সঙ্গে বরাবরই আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো।
‘শুধু একটি বিষয়ে একটু খটকা। ‘সেটা এই নূর চৌধুরী।’ যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁর কী মনে হয়, নূর চৌধুরী খুনের বিচারের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে? আন্তরিক হাসিমুখটা মলিন হয়ে যায় শেখ হাসিনার।
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, আমি তা–ই মনে করি।’
২.
১৯৭১ সাল থেকেই কানাডার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের। শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর যে দেশগুলো প্রথম স্বীকৃতি দেয়, কানাডা তার একটি। নিহত হওয়ার দুই বছর আগে কমনওয়েলথের সভায় যোগ দিতে কানাডায় এসেছিলেন শেখ মুজিব। তাঁকে সেখানে স্বাগত জানিয়েছিলেন কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো।
কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দেখা দেয় খাদ্যাভাব ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। তখন এনবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খাদ্যাভাব, দুর্নীতি ও দারিদ্র্য কোনোভাবেই সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
‘শুরু থেকেই এগুলো শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শেখ মুজিব গণমাধ্যম জাতীয়করণ করেন, বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দেন এবং একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেন, যাদের বিরুদ্ধে বিরোধী মত দমনের অভিযোগ ওঠে। এই সুযোগে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটেন।
ফিফথ এস্টেট একজনকে খুঁজে পায়, যিনি সেই কালরাতের ঘটনার একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী এবং সে রাতে আসলে কী ঘটেছিল, তা বলতে পারবেন।
তিনি আবদুর রহমান শেখ রমা। ১৯৭৫ সালে তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর। শেখ মুজিবের বাড়িতে কাজ করতেন। এ ছাড়া খেলার সাথি ছিলেন রাষ্ট্রপতির ১০ বছর বয়সী শিশুপুত্র রাসেলের।
রমা ও তাঁর ১৭ বছর বয়সী কন্যা ফৌজিয়া রহমান শেখের সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায় ফিফথ এস্টেট। সেখানে ফৌজিয়া তাঁর বাবার কথা অনুবাদ করে দেন। ফৌজিয়া বলেন, সেই রাতে তাঁর বাবা ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি।
শেখ মুজিবের বাড়িটি বর্তমানে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে সেই রাতের বুলেটের সব ক্ষত আর রক্তের দাগগুলোকে প্লেক্সিগ্লাসের নিচে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
রমা বলেন ‘পুরো পরিবার বাথরুমে [লুকিয়ে ছিল]। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।’
শেখ মুজিবের পেছন পেছন সিঁড়িটির মাথা পর্যন্ত এসেছিলেন রমা। সেখানেই রাষ্ট্রপতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মেয়ে ফৌজিয়া বলেন, তাঁর বাবা নিজের চোখে দেখেছেন সেই ঘটনা। মেয়ের কথা শুনতে শুনতে চোখ মুছছিলেন রমা।
‘যতবার বাবা এখানে আসেন, ভীত হয়ে পড়েন। তাঁর দমবন্ধ হয়ে আসে। খারাপ লাগে।’ জানান ফৌজিয়া।
সেই রাতে মোট ২২ জনকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১৪ জন ছিলেন রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, ভাই, গর্ভবতী পুত্রবধূ ও তিন ছেলে। ছোট ছেলের বয়স ছিল ১০ বছর। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, মাকে দেখতে চাওয়ার পরপরই তাঁর ওপর গুলি চালানো হয়।
শেখ মুজিবের পরিবারের মাত্র দুই সদস্য সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যান। বেঁচে যাওয়া এই দুই কন্যা ছিলেন ইউরোপে। তাঁদেরই একজন শেখ হাসিনা।
‘সেদিন, আমরা বেলজিয়ামে ছিলাম,’ বলেন শেখ হাসিনা।
‘জার্মানিতে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রদূত আমাকে ঘটনা জানান। কিন্তু আমি আমার বোনকে বলতে পারছিলাম না। আমি গিয়ে তাঁকে শুধু জড়িয়ে ধরলাম।
কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না,’ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে শেখ হাসিনার। চোখ মোছেন।
‘খুব কঠিন সময় ছিল সেটা।’
সেই হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক সরকার ওই হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেয় এবং তাঁদের অনেককেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক পদে বসায়। নূর চৌধুরী প্রথমে ব্রাজিল ও আলজেরিয়ায় দায়িত্ব পান। পরবর্তীকালে তাঁকে ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করা হয়। তারপর ১৯৯৬ সালে হংকংয়ে কূটনৈতিক পদে থাকা অবস্থায় একদিন তাঁর নিখোঁজ হওয়ার খবর আসে।
নূর চৌধুরীর হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার দায়িত্ব গ্রহণের একটি সম্পর্ক আছে। কেননা, নূর চৌধুরী যে মানুষটিকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত, তাঁর মেয়েই তখন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।
৩.
১৯৭৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি একদিন লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদকে তার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজের গাড়িতে উঠতে বলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে যান ঢাকার একটি নির্জন স্থানে।
পথে আলাপকালে মহিউদ্দিন আহমেদের মনে হয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছেন। ওই কর্মকর্তা তাঁর কাছে জানতে চান, রাষ্ট্রপতি যে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে বিষয়ে তিনি কী ভাবছেন?
মহিউদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁরা দুজন ঢাকার একটি নামী হোটেলের কাছে একটি নির্জন পার্কে এসে নামেন। পরে সেখানে আরও দুজন আসেন। পায়ে হেঁটে। তাঁদেরই একজন বর্তমানে পশ্চিম টরোন্টোর বাসিন্দা নূর চৌধুরী।
মহিউদ্দিন আহমেদ পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে আরও বলেন, তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এরপর ওই দুজনের সঙ্গে একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন।
তিনি জানান, সেই ‘গোপন আলোচনা’ দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র চলছে।’
বাংলাদেশের পুলিশের কাছে দেওয়া বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিযুক্তের জবানবন্দী হাতে পায় ফিফথ এস্টেট। মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁদের একজন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের তদন্তে মহিউদ্দিনসহ প্রায় ৫০০ জনকে কয়েক মাস ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
শেষ পর্যন্ত নূর চৌধুরীসহ ১৫ জন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত হন।
সেই তদন্তের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষ পুলিশ অফিসারদের একজন। তিনি বলেছেন, নিঃসন্দেহে নূর চৌধুরী এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন।
ফিফথ এস্টেটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘আমি শতভাগ নিশ্চিত। আমার কাছে স্পষ্ট, কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কেননা, আমি নিজে সাক্ষীদের জবানবন্দী নিয়েছি।’
চাকরিজীবন শেষে কাহার এখন অবসরে। তাঁকে যখন বলা হলো, নূর চৌধুরী নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন এবং বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত বিচার ব্যবস্থার শিকার, তখন কাহার সজোরে মাথা নাড়াতে থাকেন।
নিজ বাসার ছাদে বসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এটি সর্বৈব মিথ্যা।’
‘অভিযুক্তরা নিজেরাই সংবাদমাধ্যমে নিজেদের দোষ স্বীকার করেছেন এবং তাঁরা সবাই নূর চৌধুরীর নাম বলেছেন।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার তদন্তে যেসব সাক্ষ্য ও জবানবন্দী নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হাতে পাওয়ার পর সেই কালরাতে ও তার আগে কী কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারে ফিফথ এস্টেট।
কাহার বলেন, মহিউদ্দিন আহমেদ দেখেছেন, ওই গোপন বৈঠকটিতে নূর চৌধুরী ছিলেন। মহিউদ্দিন তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। কারও কারও চোখে সেগুলোকে স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে।
শেখ মুজিবের বাসভবনের একজন প্রহরী তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, ওই দিন ভোরে গুলি আসতে শুরু করলে তিনিসহ সেখানে যাঁরা ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালের পেছনে শুয়ে পড়েন।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী দফাদার বশির আহমেদ জানান, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং দেখেছেন নূর চৌধুরী ও অন্যরা কোমরের কাছে বন্দুক ধরে সামনের দিকে তাক করে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢোকেন।
নূর চৌধুরী ও অন্যদের পেছন পেছন এগোতে থাকেন আরেক প্রহরী হাবিলদার মো. কুদ্দুস শিকদার। নূর চৌধুরী ও অন্যরা মিলে যে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছেন, তা তিনি দেখেছেন।
‘মেজর নূর ও আরেকজন ষড়যন্ত্রকারী শেখ মুজিবকে তাঁদের হাতে থাকা সাবমেশিনগান দিয়ে গুলি করেন। গুলিতে তিনি সিঁড়িতে পড়ে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন।’
পরিশেষে বশির বলেন, নূর চৌধুরী তাঁকে এবং ঘটনার পর বাড়ির বাইরে অন্য আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের জড়ো হওয়া দেখে বলেছিলেন, ‘আমিই শেখ মুজিবুর রহমানকে গুলি করেছি।’
৪.
এরপর ১৯৯৬ সালে হংকং থেকে নিখোঁজ হয়ে যান নূর চৌধুরী।
তার কিছুদিন আগেই তাঁকে পদ থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বছর জুন মাসে ‘নিখোঁজ কূটনীতিক নিয়ে জল্পনা বাড়ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাউথ চায়না মর্নিং। এতে বলা হয়, হংকং ছাড়ার পর নূর চৌধুরী ঢাকায় আসতে ব্যর্থ হন।
পরে কানাডায় আদালতে জমা দেওয়া নথিতে নূর চৌধুরী সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে: তিনি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যুদ্ধের পরে তিনি দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে ভালোভাবেই সংযুক্ত ছিলেন। তবে তিনি কখনোই সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না।
‘এরপর ১৯৭৪ সালের মধ্যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নীতির সাথে তাঁর মতানৈক্যের কারণে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।’
‘পদত্যাগের পর তিনি ব্যবসা করেছেন। সিগারেট, ডিজেল ইঞ্জিন এবং অফিস সরঞ্জাম আমদানি ও রপ্তানি করতেন।’
আদালতের নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘নূর চৌধুরী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি [শেখ] মুজিবের শাসনামলের দুর্নীতি ও অত্যাচারের প্রকাশ্য সমালোচক হিসেবে পরিচিত।’
আদালতের ওই নথিতে হংকং থেকে তাঁর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর কী কী ঘটেছিল, তার বর্ণনাও রয়েছে। হংকং থেকে দেশে না ফিরে ১৯৯৬ সালের ৫ জুলাই তিনি কানাডায় যান। সেখানে গিয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
এর তিন মাস পর বাংলাদেশে আরও ১৮ জনসহ তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালে হত্যাকাণ্ড সংঘটনের অভিযোগ দায়ের হয়। বাংলাদেশের পুলিশ নূর চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ইন্টারপোলও আন্তর্জাতিক রেড নোটিশ দেয়। এরপর থেকেই নূর চৌধুরী একজন ‘ওয়ান্টেড ম্যান’।
১৯৯৭ সালে, যখন কানাডায় শরণার্থী হিসেবে নূর চৌধুরীর আশ্রয় প্রার্থিতার আবেদনের ওপর আইনি প্রক্রিয়া চলছে, তখন বাংলাদেশেও শুরু হয় ১৯৭৫-এর হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিচারের জন্য কোনো তাড়াহুড়ো করা হয়নি। আমি জোর দিয়ে যা বলতে চাই, তা হচ্ছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সব রকমের অধিকার ও সুযোগ অভিযুক্তদের দেওয়া হয়েছিল।’
এই মামলাটি সম্পর্কে আনিসুল হকের চেয়ে ভালো সম্ভবত আর কেউ জানেন না। কারণ, তাঁর পিতা স্বাধীনতার আগে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত আইনজীবী ছিলেন। শেখ মুজিবের ঘাতকদের বিরুদ্ধে করা মামলায়ও প্রসিকিউটর হয়েছিলেন তিনি। আনিসুল হক শুরুতে এই মামলার একজন জুনিয়র প্রসিকিউটর হিসেবে যুক্ত হন। এরপর ২০০২ সালে তাঁর বাবা মারা গেলে, তিনি প্রধান প্রসিকিউটরের দায়িত্ব নেন।
আনিসুল হক ঢাকায় তাঁর অফিসে বসে সিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে নূর চৌধুরী সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং যাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছিলেন, নূর চৌধুরী তাঁদেরই একজন।’
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অনুষ্ঠিত বিচারকাজের সময় নূর চৌধুরী অনুপস্থিত ছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। পুরো আপিল নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে মোট ১২ বছর। চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয় ২০০৯ সালে। রায়ে আরও ১১ জনসহ নূর চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
কানাডায় আসার পর থেকে নূর চৌধুরী বাইরে খুব একটা বের হন না। অবশ্য ২০১১ সালে তিনি সিবিসি রেডিওর ‘দ্য কারেন্ট’ অনুষ্ঠানে একবার প্রকাশ্যে কথা বলেছিলেন। তখন তিনি জোরালোভাবে দাবি করেছিলেন, ১৯৭৫ সালে সংঘটিত অভ্যুত্থানে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নির্দোষ। আমি রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করিনি। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি কানাডা সরকারের কাছে ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা চাই।’
তাঁর দাবি ছিল, সমালোচক হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ সরকার তাঁর পিছনে লেগেছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর আমার আস্থা নেই। সেখানে ন্যায়বিচার কেনাবেচা হয়। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে তার প্রমাণ রয়েছে।’
শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পেতে তিনি কানাডায় যে আবেদন করেন, তাতে দাবি করা হয়, যেদিন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়, সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য টি-শার্ট তৈরি করছিলেন তিনি।
২০০২ সালে কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড তাঁর আবেদনের বিষয়ে রায় দেয়। রায়ে বলা হয়, নূর চৌধুরী তাঁর আবেদনে যে গল্প বলেছেন, সেটা কানাডা বিশ্বাস করেনি।
এ ছাড়াও তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সময় নিজের অবস্থান সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, তা সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। রায়ে এ-ও বলা হয় যে, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কানাডা নিশ্চিত যে তিনি আসলেই সেই হত্যাযজ্ঞের ‘ষড়যন্ত্রকারীদের একজন’।
রায়ে বলা হয়েছে: ‘নূর চৌধুরী যে বিচারে দণ্ডিত হয়েছেন, তাতে অন্যায়ভাবে কিছু করা হয়েছে—এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং তিনি ন্যায়বিচার থেকে পলাতক ছাড়া আর কিছুই নন।’
একাধিক আপিল ও ফলোআপ শুনানির পর কানাডা ২০০৬ সালে তাঁর প্রত্যাবাসন বা দেশত্যাগের আদেশ জারি করে।
তাহলে ১৭ বছর পর এখনো কীভাবে নূর চৌধুরী কানাডায় নির্বিঘ্নে থাকতে পারছেন?
৫.
প্রতিবছর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে তীব্র গরম উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ পোস্টার, ব্যানার নিয়ে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ির বাইরে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে সম্মান জানাতে।
এদিন স্মৃতিস্তম্ভটিতে সবার প্রথম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন শেখ মুজিবের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পরিবারের নিহত ১৪ সদস্যের কবরে গোলাপের পাপড়ি ছিটান তিনি।
তবে এখন অতীতের বেদনাদায়ক স্মৃতির চেয়ে শেখ হাসিনাকে বেশি লড়তে হচ্ছে সমালোচকদের বিরুদ্ধে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতি এবং গত অক্টোবরে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশের পরে বিরোধী দলীয় শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ওই বিক্ষোভে তিনজন অংশগ্রহণকারী ও একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের কথা রয়েছে। এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাড়ছে শঙ্কা।
এদিকে হাসিনার বাবাকে গুলি করে হত্যায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি মুক্ত জীবনযাপন করছেন কানাডায়।
হাসিনা দ্য ফিফথ এস্টেটকে বলেন, ‘আমরা কানাডিয়ান সরকারকে অনুরোধ করেছি তাঁকে ফেরত পাঠাতে। কারণ, তিনি কানাডার নাগরিক নন। তিনি শুধু [সেখানে] আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা কানাডার কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’
নূর চৌধুরীর লিগ্যাল স্ট্যাটাস প্রকাশে কানাডার অস্বীকৃতি হাসিনার হতাশা আরও বাড়িয়েছে।
২০০৬ সালে দেশত্যাগের নির্দেশনার পর ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা বাংলাদেশে চৌধুরীর নিরাপত্তাঝুঁকির একটি মূল্যায়ন করে। কিন্তু সেটির ফলাফল বাংলাদেশকে জানতে দেয়নি তারা।
শেষে সেই মূল্যায়নের ফল জানতে কানাডা সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ফেডারেল কোর্টে মামলা করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের যুক্তি ছিল, কানাডার সাথে আলোচনা এগিয়ে নিতে এবং পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ওই নিরাপত্তা মূল্যায়নের ফল তাদের জানা জরুরি।
এরপর নূর চৌধুরীর নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে মূল্যায়ন প্রকাশে কানাডা সরকারের অনিচ্ছার বিষয়টা পুনর্বিবেচনার আদেশ দেয় ফেডারেল কোর্ট। কানাডা সেটি করেও। কিন্তু এরপর আবারও তারা বাংলাদেশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কানাডার সরকারি তিনটি বিভাগ ও অফিসে চিঠি পাঠিয়েছিল ফিফথ এস্টেট। এগুলো হলো: জাস্টিস, ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর।
জবাবে একটি লিখিত উত্তর পাঠায় কানাডার সরকার। তাতে বলা হয়, ‘কানাডার গোপনীয়তা–সংক্রান্ত আইনের কারণে ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা কোনো একটি ঘটনায় সম্পর্কিত সবার সম্মতি ছাড়া সে বিষয়ে মন্তব্য করতে পারে না। কানাডা সরকার তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে না।’
মন্তব্য করতে রাজি না হলেও ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো কানাডা সরকারের একটি চিঠি হাতে পায় দ্য ফিফথ এস্টেট। সেখানে নূর চৌধুরীরকে নিয়ে কানাডার অবস্থানের একটি ধারণা পাওয়া যায়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যদিও [চৌধুরীর অবস্থান সম্পর্কে] তথ্য প্রকাশ করার কিছু সুফল থাকতে পারে, যেমন কানাডা অপরাধীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়—সেটার প্রমাণ দেওয়া বা কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা ইতিবাচক হতে পারে। কিন্তু তা করলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের অপসারণের বিষয়ে কানাডার যে ঘোষিত অবস্থান রয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তা সমুন্নত রাখার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার ব্যত্যয় ঘটবে।’
‘তা ছাড়া এই সুবিধাগুলো মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে কানাডার অবস্থান রক্ষার চেয়ে বড় নয়।’
প্রসঙ্গত, কানাডা ১৯৯৮ সালে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে।
ফিফথ এস্টেটের পক্ষ থেকে নূর চৌধুরীর আইনজীবীর মাধ্যমে তাঁকে বারবার সাক্ষাৎকারের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। অবশেষে তাঁর দেখা পাওয়া যায় পশ্চিম টরোন্টোতে, নিজের কনডোমিনিয়ামের বাইরে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, মুজিব হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি কানাডিয়ানদের কাছে সত্য বলেছেন কি না।
তবে এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করেন।
২০০১ সালে, যখন কানাডার সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যু বা নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকা কাউকে দেশে ফেরত পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন এটিও বলা হয়েছিল যে বিশেষ পরিস্থিতিতে এর অন্যথাও হতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার বিশ্বাস করে, একজন রাষ্ট্রপ্রধান এবং ১০ বছরের একটি শিশুসহ ২১ জনকে হত্যার পরিকল্পনায় সহায়তা করা সে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি তৈরি করে বৈকি। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি কানাডার সুপ্রিম কোর্টে তুলতে চায়।
বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে কানাডার একজন মন্ত্রীর সাথে বৈঠকের অনুরোধ জানিয়ে আসছে। কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার বলেন, সেই অনুরোধ কানাডা প্রত্যাখ্যান করেছে।
রাষ্ট্রদূত খলিল আরও বলেন, নূর চৌধুরীর দণ্ডিত হওয়ার পর থেকে সাধারণ পর্যায়ের বৈঠকগুলো থেকে তাঁর প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আসেনি।
‘কানাডা বসতে চায় না বলে কোনো আলোচনাও হয়নি,’ বলেন হাই কমিশনার।
‘যদি আপনার সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে “না, তাঁকে দেশে পাঠানো যাবে না”, আমরা মেনে নেব’, তিনি যোগ করেন।
‘তারপর হয়তো আমরা অন্য বিকল্পগুলো নিয়ে কথা বলতে পারি।’
আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ রব কুরির মতে, আলোচনা অব্যাহত রাখাই মূল বিষয়।
‘এখানে এটা স্পষ্ট যে [এই কেসটি] একটা গ্যাঁড়াকলে পড়েছে,’ তিনি বলেন।
‘এর সমাধানের পথে কিছু আইনি প্রক্রিয়া আছে। …তা নিয়ে বাংলাদেশে হতাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। কানাডিয়ানদের বিভিন্ন মহলেও হতাশা রয়েছে। আমরা সকলেই দেখতে চাই যে কেসটির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বা অগ্রগতি হচ্ছে। আমরা জানি না ব্যাপারটি কী, তবু বলব, সেটি করার ক্ষেত্রে সরকারের অক্ষমতা বা প্রত্যাখ্যান রহস্যজনক।’
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available