ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: স্বার্থপরতার এই দুনিয়ায় মোন্তাকিম আলিফ (২৫) একেবারেই ব্যতিক্রম। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও মেয়ে সহকর্মীর প্রাণ বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সহকর্মীকে সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেও নিজেই রক্ষা পাননি। তাদের ছুরিকাআঘাতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় আলিফের।
২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মোন্তাকিম আলিফ রাজধানীর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন এই যুবক।
জানা গেছে, অফিসের নাইট শিফট শেষ করে ভোর রাতে আলিফ তার সহকর্মীকে (নারী) বাসায় এগিয়ে দেওয়ার সময় কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে তিনজন বখাটে ছেলে ছিনতাই ও মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করার জন্য কাছে আসে। এসময় মোন্তাকিম আলিফ মেয়েটিকে ছিনতাইকারীদের সামনে থেকে সরিয়ে দেয় এবং তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেন। মেয়েটির ভাষ্যমতে আলিফ ওই তিনজনকে মারধরও করেছে। তবে ছিনতাইকারীরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আলিফ মেয়েটিকে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে বলে যাতে মেয়েটির কিছু না হয়। এসময় ছিনতাইকারীরা আলিফের শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। তৎখনিক আলিফকে হাসপাতালের নিলে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়।
আলিফের এমন মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকাবাসী শোকে কাতর। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল ইউনিয়নের দোগাছি মধুপুর গ্রামে। থাকেন জেলা শহরের টিকাপাড়ায়। আলিফের মৃত্যুর খবরে তাঁর বাড়িতে ভিড় করছে আত্মীয়স্বজনরা। তাঁর বাবা জুলফিকার আলী ও মা কহিনুর বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। উপস্থিত সবার চোখে পানি।
আলিফের মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমার কলিজার ধনকে আনে দেও। আমার ধনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। আহা রে ধনটা কই গেল। ভালো করে লেখাপড়া করবে, সেজন্য ঢাকা শহরে ভালো কলেজ ভর্তি করালাম। মাসে মাসে এখন আমি কাকে টাকা পাঠাব। এখন আমি কাক নিয়ে বেঁচে থাকব। আমাকে একা করে এভাবে চলে যাবি। আমাকে সঙ্গে করে কেনে নিয়ে গেলি না।
মোন্তাকিম আলিফ ২০১৬ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতেও চাকুরি করেন।
নিহত আলিফের বন্ধু মুনিজা হোসেন প্রিথিলা তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, একটা মানুষ নিজের জীবনের শেষটুকু দিয়ে একটা মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে গেলো। আসলে কত বড় মন হলে এবং কতটুকু ভালো মানুষ হলে একজন নিজের জীবনের শেষ সময়েও আরেক জনের জীবন বাঁচায়? কেউ বলতে পারবেন? অনেক রাগ ছিলো আমার প্রতি তোর। মাফ করে দিস আমাকে আলিফ।
শাহারিয়ার জাকির রিম্পু লিখেন, আলিফের জন্য আমরা গর্বিত। ওর মা-বাবাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। প্রিয় সন্তান আলিফকে হারানোর অভাব কেউ কোনো দিনই ওর মা-বাবাকে পূরণ করে দিতে পারবে না। কিন্তু আলিফকে নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি।
শ্রাবণী বর্মণ নামে আরেক বন্ধু লিখেন, সকাল সকাল এই নিউজটা পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর বাসা পার হয়েই আমার বাসা যেতে হতো, সেই সুবাদে আলিফকে রাস্তায় প্রায়শই দেখতাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন চাপতে। আলিফ শুধু ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতেই নিহত হয়নি, একজন মেয়েকে তাদের হাত থেকে সর্বোচ্চ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।
আলিফের আরেক বন্ধু লিখেছেন, ‘আহ জীবন! আমার সহপাঠী, ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শুরু থেকে যার সাথে ওঠাবসা, ওরে আজ হারাইলাম; অন্যকে বাঁচাইতে গিয়ে সে নিজে চলে গেল না ফেরার দেশে। আমি বাকরুদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক, ভাই।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available