কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় এবছর আলুর বাম্পার ফলন হলেও চরম সংকটে পড়েছেন কৃষকরা। স্থানীয় বাজারে চাহিদার তুলনায় অধিক উৎপাদনের ফলে আলুর দাম এতটাই কমে গেছে যে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না কৃষকরা। অনেকে বাধ্য হয়ে লোকসান মাথায় নিয়ে অর্ধেক দামে আলু বিক্রি করছেন, আবার কেউ কেউ বিক্রির চেয়ে জমিতেই আলু ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া ও নেপালে আলু রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও আশানুরূপ লাভ পাচ্ছেন না। রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট মানের আলু চাওয়া হচ্ছে, ফলে প্রচুর আলু রপ্তানির যোগ্যতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কৃষকদের দাবি, সরকার যেন সহজ শর্তে কৃষি ঋণ, রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সংরক্ষণ সুবিধা এবং ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দেয়।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে কালাই উপজেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৫০০ হেক্টর, কিন্তু কৃষকদের আগ্রহের কারণে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে দাম কমে গেছে। বর্তমানে পাইকাররা মাত্র ১০-১২ টাকা কেজি দরে আলু কিনছেন, যা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম।
কালাই পৌর এলাকার আঁওড়া গ্রামের কৃষক কফিলদ্দিন জানান, তিনি ৭০ শতক জমিতে আলু চাষে প্রায় ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। বাজারে আলুর দাম ৮-১০ টাকা হওয়ায় তিনি বিক্রি করতে পারছিলেন না। পরে রপ্তানির জন্য পাইকারদের কাছে ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন, কিন্তু তাতেও ৩২ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
বড় চাষি আমিরুল ইসলাম জানান, প্রায় ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তিনি ৯৫ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। তার হিসাবে, প্রতি একরে ২০০ বস্তা আলু হয়, যেখানে প্রতি বস্তায় ৬০ কেজি ধরলে মোট ১২ হাজার কেজি আলু উৎপাদিত হয়। এতে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ১৬.৬৬ টাকা। কিন্তু বাজারে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১০-১২ টাকা কেজি দরে, ফলে বিশাল লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি।
আহম্মেদাবাদের কৃষক মজিবর রহমান বলেন, ‘আমি ২০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিক খরচ মিলিয়ে প্রায় ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন বাজারে পাইকাররা ১০ টাকা কেজি দাম বলছে। এত কম দামে আলু বিক্রি করলে তো ঋণ শোধ করতেই পারব না!’
স্থানীয় কৃষক আব্দুল করিম বলেন, ‘জমিতে আলু থাকলে তো খরচ বাড়তেই থাকবে। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করছি। অনেক চাষি আছেন যারা হতাশায় পড়ে গেছেন, জমির আলু তুলছেনই না।’
কৃষক রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিদেশে আলু রপ্তানি হচ্ছে, শুনছি। কিন্তু আমাদের আলু সেখানেও যাচ্ছে না! রপ্তানির মানদণ্ড এত কঠোর যে বেশিরভাগ আলু যোগ্য হচ্ছে না। তাহলে আমাদের লাভ কী?’
কালাইয়ের আলু রপ্তানিকারক সাইদুর রহমান জানান, ৬ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া ও নেপালের উদ্দেশ্যে কালাই থেকে ৫টি ট্রাকে ৭৫ টন আলু চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়েছে। আরও দুই ট্রাক আলু সংগ্রহ করা হচ্ছে।
আরেক রপ্তানিকারক আবুল হাসনাত বলেন, ‘আমরা বিভিন্নভাবে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। নিয়মিত রপ্তানি চালু হলে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষকদের ক্ষতি কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট মানের (৮০-৪০০ গ্রাম ওজনের) আলু চাওয়া হচ্ছে, ফলে অনেক কৃষকের আলু বাদ পড়ে যাচ্ছে।’
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ অরুণ চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিদেশে আলুর চাহিদা বাড়ছে। সঠিক মূল্যে আলু বিক্রি করতে পারলে কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন। সরকারিভাবে সহায়তা দিলে কৃষকদের লোকসান কমানো সম্ভব হবে।’
বাম্পার ফলন হলেও লোকসানের মুখে পড়া কালাইয়ের কৃষকদের জন্য এটি এক কঠিন সময়। রপ্তানি বাড়ানো এবং সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা না হলে অনেক কৃষকই ভবিষ্যতে আলুচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তই পারে তাদের দুশ্চিন্তা দূর করতে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available