সরোয়ার আমিন বাবু, চট্টগ্রাম: যান্ত্রিক সভ্যতার মাঝেও হারিয়ে যায়নি মানুষের আবেগ অনুভূতি। আধুনিক যান্ত্রিক জীবনযাপনেও মানুষ এখনো ভালোবাসতে চায় প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ও অনাবিল সৌন্দর্যকে। ফুলকে ভালবেসে করতে চায় সুন্দরের আরাধনা। ফুলের সৌরভে তাই তো তারা ছুটে এসেছে ফুলের রাজ্যে। মেতে উঠেছে ফুলের মেলা ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যালে। হাজারও মানুষের আগমনে ও ফুলের সৌরভে পৃথিবী যেন হয়ে উঠেছে কাব্যময়।
ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনলিয়া, শিউলি, হাসনাহেনা, অপরাজিতা, চেরী, জাকারান্ডা, উইলো, উইস্টেরিয়া সহ হাজারো ফুলের সৌরভে সুরভিত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামে ডিসি পার্কে শুরু হওয়া এই ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল।
নানা প্রজাতির দেশী-বিদেশী ১২৭ প্রজাতির কয়েক লক্ষ ফুলের সমারোহে ইতোমধ্যে সেজেছে ডিসি পার্ক। আরও থাকছে নেদারল্যান্ডস হতে আনা বাল্ব হতে জেলা প্রশাসনের নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ফুটানো সাড়ে পাঁচ হাজার টিউলিপ। এ সকল ফুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রত্যেক প্রজাতির ফুলের পাশেই লেখা থাকবে তাদের নাম ও বৃত্তান্ত।
২৬ জানুয়ারি শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় ডিসি পার্কের এই ফুলের রাজ্যে ঢল নেমেছে হাজারও দর্শনার্থীর। ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভ যেন টেনে এনেছে শিশু-কিশোর এমনকি বড়দেরও।
চট্টগ্রাম জেলা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ২৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ডিসি পার্কে এই মাসব্যাপী ফুল উৎসব উদ্বোধন করা হয়। ফুল উৎসব চলবে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
'ফুলের মতো আপনি ফুটাও গান' প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বেলুন উড়িয়ে ও ফিতা কেটে ফুল উৎসবের শুভ উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মন্ত্রী পরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
চট্টগ্রাম জেলা জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফুল উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো: তোফায়েল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ১৯৪ একর জমি মাদকের আখড়া থেকে ফুলের আখড়াতে রূপান্তরকরণে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমিকা প্রশংসনীয়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ফ্লাওয়ার ফেস্টিবলের জমকালো আয়োজন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে পর্যটনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই ফুল উৎসবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা চেতনাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে। সামনের প্রজন্মের জন্য আমাদেরকেই পরিবেশ ও সুযোগ তৈরি করতে হবে।
পাশাপাশি প্রশাসনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে অন্যান্য জেলা প্রশাসকগণকেও এই ধরনের আয়োজন করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অবৈধ দখল, মাদক অভয়ারণ্যকে ফুলের বাগিচা বানানো হয়েছে। পর্যটনকে কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলে অর্থনৈতিক বিকাশে ভূমিকা রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, এই উদ্যোগ যেন ক্ষণিকের উদ্যোগ না হয় এবং এর ধারাবাহিকতা যাতে বজায় থাকে সেই আহবানে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। বাইরে থেকে যারা ডিসি পার্কে আসবে, তাদের জন্য হাউজিং ব্যবস্থা করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পরবর্তী প্রজন্মকে সুন্দর ও জঙ্গিবাদকে সমূলে নির্মূল করতে এই ধরনের কালচারাল আয়োজন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
ভূমিদস্যুদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, সরকারি জায়গা কেউ দখলে রাখতে পারবে না। জায়গা ক্রমান্বয়ে উদ্ধার করে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডিসি পার্ক, নৌকা জাদুঘর, পর্যটন বাস ও ফুল ডে ট্যুর, স্কুল বাস, বার্ড পার্ক; এই ৬টি প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও প্রতি উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ করার মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। সরকারি জমি উদ্ধার করে এই সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পাশাপাশি তিনি সকল এমপি ও সচিবকে ধন্যবাদ জানান যারা এসে উক্ত অনুষ্ঠান সাফল্যমন্ডিত ও বৃক্ষরোপণ করেছেন।
মাসব্যাপী এ আয়োজনকে আরও আকর্ষণীয় করতে ফুলের প্রদর্শনীর পাশাপাশি কয়েকটি সেল্ফি জোন করা হয়েছে। পর্যটকদের জন্য থাকছে সাম্পান বাইচের আয়োজন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য রক্ষার্থে থাকবে বিভিন্ন সময়ের ১৫টি নৌকা প্রদর্শনী। চট্টগ্রাম জেলার চিত্রশিল্পীদের প্রায় ২০০টি চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর জন্য থাকবে। আগত দর্শনার্থীদের নিজেদের ছবির ক্যারিকেচার আঁকার ব্যবস্থা থাকবে।
বিনোদন প্রেমীদের জন্য থাকবে সানসেট ভিউ পয়েন্ট, পিজিওন কর্ণার, স্যুভেনির শপ, দিঘীতে কায়াকিং এর ব্যবস্থা, লোনা পানির ঝর্ণা। আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ট্যুরিস্ট শেড, নামাজের ব্যবস্থা, বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্টল সহ পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যাবস্থা থাকবে। শিশু- কিশোরদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, দোলনা, সীসঅ, স্প্রিং টয়, মেরিগো রাউন্ড, দোলনা, প্লে পেন, ফুট ট্রাম্পোলাইন সহ থাকবে নানা আয়োজন। পুরো ফুল উৎসবকে জাঁকজমকপূর্ণ করতে আয়োজন করা হবে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির অংশগ্রহণে মাল্টি কালচারাল বিশেষ আয়োজন, ঘুড়ি উৎসব, ফায়ার ওয়ার্কস, ভায়োলিন শো, পুতুল নাচ, জাদু প্রদর্শনী। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার শিল্পীদের পরিবেশনায় থাকবে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।
প্রসংগত গত বছরের ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে মাদকের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে জেলা প্রশাসন ১৯৪.১৩ একর খাস জায়গা অবৈধ দখলদারদেরকে উচ্ছেদ করে উদ্ধার করে। উদ্ধার করা জায়গায় মাত্র একমাসের মধ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী চট্টগ্রামে প্রথম ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়। সে সময় ১২২ প্রজাতির ফুলের চমকপ্রদ প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদযাপন করা হয়েছিলো ফুল উৎসব ২০২৩। দশদিন ব্যাপী এ ফুল উৎসবে প্রতিদিন গড়ে চল্লিশ হাজার পর্যটক ভ্রমন করেন ডিসি পার্ক। মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ জেলা প্রশাসনকে অনুপ্রেরণা যোগায়। এমন অনুপ্রেরণা থেকেই প্রতিবছর এ আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available