অভি হাসান দেওয়ান, মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের শিবালয়ে কৃষি পরামর্শ নিতে আসা কৃষককে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একইসঙ্গে ওই কৃষকের সঙ্গে বাজে আচরণেরও অভিযোগ কৃষি অধিদপ্তরের মাঠকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনার বিচার চাইতে গিয়ে ওই মাঠকর্মীর উপরস্থ কর্মকর্তার অসদাচরণের শিকার হওয়ারও অভিযোগ করেছেন তিনি। নারী ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ওই কৃষক ও এক ব্যক্তির কথোপকথনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছিল সেখানে?
কৃষক ফজলুর রহমান এবং সেখানে উপস্থিত একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও কৃষি অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। সেখানে উঠে এসেছে সেখানে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা।
২ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরের ওই ঘটনায় একদিনের সময় দিয়ে এরই মধ্যে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বিষয়টি খবরের পাতা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। তবে এ নিয়ে শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পোকার আক্রমণে মরে যাওয়া ধানের গোছা নিয়ে কৃষি অধিদপ্তরে আসেন ওই এলাকার ষাটোর্ধ কৃষক ফজলুর রহমান। অধিদপ্তরের মাঠকর্মী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন সুজনের কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে সেবা দেওয়ার জন্য ওই কৃষককে নিজের কক্ষে ডেকে নেন মো. সালাহউদ্দিন। তাঁর কাছে সমস্যা জানতে চান। তবে তিনি সমস্যা না জানিয়ে জেলার কৃষি কর্মকর্তার নাম্বার চান। জানান, আগের বছর জেলা কৃষি কর্মকর্তা তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। তবে মাঠকর্মী তাকে নিজেরাই সহযোগিতা করবেন বলে জানান। তাতে আপত্তি জানিয়ে কৃষক শুরু করেন তর্ক। বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন : মাঠে ফিরছেন লিওনেল মেসি
ওই কৃষক কৃষি অধিদপ্তরের কার্যালয় ত্যাগ করেন। ফোন করে ডেকে নেন স্থানীয় এক সংবাদকর্মীকে। এরপর আবার তারা কৃষি অফিসে যান। বিষয়টি নিয়ে নালিশ দিয়ে মাঠকর্মীর শাস্তি চান। সেখানে তাকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া ও কৃষকের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দেন ওই নারী কর্মকর্তা। তবে এরমধ্যেই তৃতীয় কারো সঙ্গে কথা হয় তার। সেই কথোপকথনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
যা জানালেন কৃষক ফজলুর রহমান
কৃষি অধিদপ্তরে গিয়ে সরাসরি মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি অফিসারের মোবাইল ফোন নম্বর চান ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি ধান নিয়ে গেছি পোকে খাওয়া। কইলাম, আপনেরা মানিকগঞ্জ যে জেলা অফিসার আছে তারে একটু ফোন দেন। ভিডিও কইরা দেখান। কোন ওষুধ দিতে বলে, আমি দিয়া দিমানি।’
মাঠকর্মী যেতে অস্বীকার করেছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উনাকে দেখাইছি। বলছি দেখেন। আর আপনেরা যদি ওষুধ না দেন, তাইলে জেলার উনার সাথে আমার পরিচয় আছে, জেলা অফিসার। গত বছর ধান নিয়ে গেছি। সে আমাকে ডেকে নিয়ে সাজেশন দিল। তাইতে আমি উনার নাম্বার চাইছি। তারমধ্যে এ ধরনের আচরণ করলো। আমাকে এইগুলা বললো। চারপাঁচজন লোক এগুলা বললো।’
এরপরই তার সঙ্গে অসদাচরণমূলক বাক্য বিনিময় হয় বলেও জানান এই কৃষক। এরপরই তিনি সাংবাদিককে কল দেন। সাংবাদিককে নিয়ে তিনি ফের সেই অফিসে যান। যে সময় ওই বাক্য বিনিময় হয় তখন তিনি নারী কর্মকর্তাকে দেখেননি বলেও জানান। ফজলুর রহমান জানান, নারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি।
মহিলা কর্মকর্তা কি বলেছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাড়ি চইলা আইছি। উনার কাছে যাই নাই।’
যা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
ওই কৃষকের সঙ্গে মাঠকর্মী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন সুজনের বাক্যবিনিময়ের সময় সেখানেই উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় আব্দুল আলীম ও অধিদপ্তরের কর্মী তপন সাহা। সরাসরি প্রত্যক্ষ করা দুই ব্যক্তির বক্তব্যই প্রায় মিলে যায়।
কী হয়েছিল সেখানে, এমন প্রশ্নে আব্দুল আলীম বলেন, ‘ওই মুরুব্বি বাইরে ছিলেন। তারপর তাকে কর্মকর্তা কক্ষে ডেকে নেন। আমিও একটা কাজে সেখানে ছিলাম। তখন মুরুব্বি সরাসরি জেলা কর্মকর্তার নাম্বার চান। এইটা নিয়েই তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি শুরু হয়। ওই কর্মকর্তা নিজেই দেখতে চান বলে দেন। আর মুরুব্বি বলে জেলা কর্মকর্তাকে বলবে। এটা নিয়েই তর্ক হয়।’
এছাড়া আরেক প্রত্যক্ষদর্শী তপন সাহা বলেন, ‘আমি ঘটনার সময় ওই রুমেই ছিলাম। ওই অফিসারকে মুরুব্বি নাম্বার দিতে বলেন। আর অফিসার বলে, আপনি আমাকেই বলেন কী সমস্যা। তখন মুরুব্বি তাকে বেয়াদব বলেন। আর বলেন, তোমরা প্রধানমন্ত্রীর চাকরি করো। আমরা বেতন দেই। এসব কথা বলতে বলতেই তিনি বেরিয়ে যান।’
আলোচিত ‘আমি কি আপনার কামলা দেই, আপনি কি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন’
‘আমি কি আপনার কামলা দেই, আপনি কি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন’ সালাহউদ্দিন সুজন ফজলুর রহমানকে এমন কথা বলেছেন বলে উঠে এসেছে একাধিক সংবাদমাধ্যমে।
ফজলুর রহমানকে এই উদ্ধৃতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, এই কথা কে বলেছে এমন প্রশ্নে ফজলুর রহমান বলেন, ‘কে বলছে অফিসে আইসা জিজ্ঞেস করেন। ওরাই বলবো। কইছে, প্রেসিডেন্ট নাকি, কামলা নাকি তোমার।’
মো. সালাহউদ্দিন সুজন বা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিয়া তরফদার ওই কথা বলেছেন কি-না সে বিষয়েও সদুত্তর দিতে পারেননি কৃষক ফজলুর রহমান।
প্রত্যেক্ষদর্শী আব্দুল আলীমের কাছে সালাহউদ্দিন সুজন এমন কোনো কথা বলেছেন কি-না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এরকম কিছু বলতে শুনি নাই।’
প্রত্যেক্ষদর্শী তপন সাহার কাছেও আলোচিত এই মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো এমন কিছু শুনি নাই। কাউকেই তো বলতে শুনি নাই।’
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা এমন কথা বলতে শোনেননি এই বিষয় তুলে ধরলে ফজলুর রহমান বলেন, ‘বলছে, বলছে একেবারে ১০০ বার। মিথ্যা কথা কেন বলুম।’
এছাড়া ফজলুর রহমান কৃষি অধিদপ্তরে কেঁদেছেন কি-না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ডিডি স্যার কল দিছিল, আমি কানছি। তবে অফিসে কান্নাকাটি করিনি।’
যেভাবে বিতর্কে কৃষি কর্মকর্তা
একবার চলে যাওয়ার পর সাংবাদিকসহ দ্বিতীয়বার কৃষি অধিদপ্তরে আসেন কৃষক ফজলুর রহমান। ওই সময় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিয়া তরফদারের কক্ষে গিয়ে সাংবাদিকরা কৃষকের এই অভিযোগের বিষয়টি জানান।
রাজিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সাংবাদিকদের সামনে কৃষকের সঙ্গে ধমকের স্বরে কথা বলেন এবং আচরণ ঠিক হয়নি বলে তার দিকেই অভিযোগ তুলেন এবং ইংরেজিতে নানা বুলি আওড়ান। সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ করলে তিনি তাদের ওপরও চড়াও হন এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
ওই ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে এক ব্যক্তিকে ভিডিও করতে দেখে রাজিয়া বলেন, ‘আপনি অফ করেন ওইটা। উইদাউট পারমিশন আপনি ভিডিও করতে পারেন না।’
জবাবে ভিডিও করা ব্যক্তি তাকে বলেন, ‘আপনি কৃষকের সামনে ইংলিশে কথা বলেন। কৃষক কি ইংলিশ বোঝে? দুইবার এ কথা বলা হয়। আপনি কেন একজন লুঙ্গি পরা লোকের সাথে আপনি কেন তাকে আপনার অফিসের লোকজন বলবে হচ্ছে যে আসছেন আমি দেখতেছি। তাহলে কৃষককে কেন এটা (বের) করা হলো? কৃষককে কেন বের করে দেওয়া হলো।’
রাজিয়া জবাব দিতে গেলেও ভিডিও করা ব্যক্তি তাকে বলতে থাকেন, ‘একজন কৃষক আসছে। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, সে লুঙ্গি পরে আসছে, স্যান্ডেল পরে আসছে, আপনি কৃষককে ভালো মতো দেখবেন।’
ধমকের সুরে বলেন, ‘একটা কৃষক কেন মন খারাপ করে বেরোয় যাবে এটা বলেন। একইসঙ্গে আরও কয়েকজন তাকে কৈফিয়ত করেন। এছাড়াও আরও ধমক দিতে থাকেন।’
এতে রাজিয়া বলেন, ‘অযথা বের করা হয় নাই। কৃষককে নিয়ে এখানে মিসবিহ্যাভ করছেন।’
এদিকে এ ঘটনার পরপরই কৃষকের অভিযোগের ভিত্তিতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সালাউদ্দিন সুজনকে কৈফিয়ত তলব করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিয়া তরফদার। কৈফিয়ত তলবে তিন কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যাসহ জবাব দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগটি চাকুরি বিধিমালার পরিপন্থি হওয়ায় কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে না তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে মো. সালাহউদ্দিন সুজন বলেন, ‘আমি ওই কৃষককে ডেকে নিজের কক্ষে এনে তার সমস্যা জানতে চাই। তখন তিনি অসদাচরণ করেন। একপর্যায়ে স্থান ত্যাগ করেন। কিছুক্ষণ পর আবারও লোকজনসহ আসেন। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই বিষয়ে আমাকে নোটিশ দিয়েছেন। আমি জবাব দেব।’
কৃষকের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এমন কোনো মন্তব্য করিনি। সেখানে আরও অনেকেই ছিল। তারাও দেখেছেন। এতো কিছুর পরও জনগণের সেবক হিসেবে আমাদের স্যার তার সমস্যা শুনে সমাধান দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিয়া তরফদার বলেন, ‘কৃষক ফজলুর রহমান মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দুপুরে ধানের চারার সমস্যা নিয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য অফিসে আসেন। কৃষক ফজলুর রহমানের সাথে উপসহকারী কৃষি অফিসার সালাউদ্দিন সুজনের কথোপকথনের এক পর্যায়ে বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। এছাড়া কৃষকের অভিযোগ তার জমি পরিদর্শন করেন নাই। যে কারণে দায়িত্বশীলতা ও মাঠ ব্লকের বিভিন্ন কর্যক্রমে গাফলতির দায়ে ওই কর্মকর্তাকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষক ফজলুর রহমান আমার নিকট আসলে আমি মনোযোগ দিয়ে তার সমস্যা ও অভিযোগ শুনি। তার সাথে আমার কোন প্রকার অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনা ঘটেনি।’
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রবিআহ নূর আহমেদ জানান, ‘কৃষি অফিসের দায়িত্বই হচ্ছে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কাজ করা। সেখানে কৃষকের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সাথে তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের বোরো খেত দেখতে ঘটনাস্থলে জেলা থেকে একজন কর্মকর্তা পাঠানো হবে এবং সার্বিক পরামর্শসহ সহযোগিতা করা হবে।’
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available