মানিকগঞ্জে চাঞ্চল্যকর মাহমুদা হত্যা মামলায় দুইজনের মৃত্যুদণ্ড

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: মানিকগঞ্জ জেলা শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকার ষ্টেডিয়াম রোডের চাঞ্চল্যকর মাহমুদা আক্তার (৪৫) হত্যা মামলায় ২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ২ জনের যাবজ্জীবন ও ১ জনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। ৮ নভেম্বর বুধবার সকাল ১১টায় মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার আসামিদের উপস্থিতিতে এই রায় দেন।

গৃহিনী মাহমুদা আক্তারকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগে মেয়েসহ মোট ৫ জনকে আসামি করে মানিকগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন মাহমুদা আক্তারের স্বামী জহিরুল ইসলাম।

স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে স্বামীর দায়ের করা মামলার আসামিরা হলো, ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ জিন্দাপীড় এলাকার মো. শফিউর রহমান নাঈম (২৫), একই এলাকার আব্দুল বারেকের ছেলে মো. রাকিব হোসেন (২৪), অভিযোগকারীর কন্যা জুলেখা আক্তার জ্যোতি (১৯), নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার পূর্ব গোলমন্ডা এলাকার মো. মাহফুজার রহমান (২০) ও একই এলাকার আব্দুল ভাসানীর ছেলে নুর বক্স।

এদের মধ্যে আসামি রাকিব ও মাহফুজার রহমানকে মৃত্যুদণ্ড, নাঈম ও জ্যোতিকে যাবজ্জীবন এবং নূর বক্সকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৬টার দিকে মামলার বাদী হাঁটার জন্য ও বাজার করার জন্য বাড়ির বাইরে যায়। পরে সকাল পৌনে ৮টার দিকে বাজার করে বাসায় ফেরৎ আসলে মেয়ে জ্যোতি বাড়ির গেট খুলে দেন। এরপর মেয়েকে তার মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞিসাবাদ করলে মা নাস্তা তৈরি করছে বলে জানান মেয়ে জ্যোতি।

সেখান থেকে ফিরে রুমের সামনে জ্যোতিকে কান্না করতে দেখে কান্নার কারণ জানতে চান তিনি। এসময় জ্যোতি এলোমেলো কথাবার্তা বললে ঘুমানোর কক্ষে গিয়ে স্ত্রী মাহমুদাকে লেপ দিয়ে ডাকা অবস্থায় দেখতে পান বাদী। ডাকাডাকিতে স্ত্রী ঘুম থেকে সাড়া না দিলে লেপ ধরে টান দিয়ে স্ত্রীর জিহ্বা বাহির করা ও নাকে রক্ত দেখতে পান মামলার বাদী।

এসময় তার চিৎকারে আশেপাশের রুমের ভাড়াটিয়ারা ছুটে আসেন। পরে মাহমুদাকে উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নেওয়া হলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

২০২০ সালের ৩১ মে মানিকগঞ্জ সদর থানার এসআই মো. শামীম আল মামুন সংশ্লিষ্ট আদালতে হত্যা মামলায় জড়িত থাকার দায়ে ৫ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় মোট ২৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ২১ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। পরে মামলার যুক্তিতর্ক শুনানী শেষে মানিকগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার বৃহস্পতিবার চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার দিন ধার্য্য করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার তদন্তে উল্লেখ করেন, জুলেখা আক্তার জ্যোতি একটু জেদী ও বেপরোয়া হওয়ায় ঘটনার প্রায় তিন মাস আগে ঢাকার ধামরাই উপজেলার গোলাকান্দা গ্রামের মারুফের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেন। বিয়ের দুই বছর পর ঢাকার কেরাণীগঞ্জের নাঈমের সঙ্গে ফেসবুকে তার প্রেম হয় এবং এক পর্যায়ে তারা শারীরিক সর্ম্পকে জড়িয়ে যায়। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে জ্যোতির স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হলে জ্যোতি মানিকগঞ্জে বাবার বাড়ি চলে আসে।

এরপর নাঈম মাঝে মাঝে জ্যোতির সঙ্গে ওই বাড়িতে অবৈধ মেলামেশা করলে জ্যোতির মা বিষয়টি বুঝতে পারে। এ নিয়ে জ্যোতিকে শাসন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে জ্যোতিকে অনত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করলে জ্যোতি নাঈমের সহায়তা নিয়ে তার মাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন।

সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রেমিক নাঈম অপরাপর আসামিদের সঙ্গে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাহমুদা আক্তারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই মোতাবেক ঘটনার আগেরদিন বিকেলে জ্যোতির কক্ষে গিয়ে অবস্থান করে নাঈমসহ মোট ৪ জন এবং সারারাত একই কক্ষে জ্যোতিসহ সকলেই অবস্থান করেন। ঘটনার দিন সকালে জ্যোতির বাবা হাঁটতে ও বাজার করতে বের হলে সকল আসামিরা জ্যোতির মায়ের কক্ষে গিয়ে দেখে তিনি সেলাই মেশিনে কাজ করছেন।

জ্যোতির সঙ্গে অপরিচিত লোকদের দেখে তিনি চিৎকার করার চেষ্টা করলে জ্যোতি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সকল আসামি জ্যোতির মাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে মরদেহটি খাটের উপরে রেখে লেপ দিয়ে ঢেকে রেখে কৌশলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবী আবদুস সালাম বলেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় জড়িত আসামিদের মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

আসামি নুর বক্সের পক্ষের আইনজীবী আমিনুল হক আকবর ও খন্দকার সুজন হোসেন বলেন, এই আসামি উপরোক্ত মামলার সথে জড়িত নয়। বিষয়টি সাক্ষ্য, জেরা ও যুক্তিতর্কের সময় তুলে আনা হয়েছে। সাক্ষ্য শেষে বিচারক নুর বক্সকে খালাস প্রদান করেন। কাজেই আমরা এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করছি।

তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার অভিমত ব্যক্ত করেন।