মধুপু (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি: ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ড এবং গারো পাহাড়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটে গারো সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। খাসিয়াদের পরেই গারোরা মেঘালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। গারোরা সাধারণত নিজেদের মান্দি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মান্দি শব্দের অর্থ মানুষ। বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসবাস করা গারোরা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব-উত্তরকে আপাল আর পশ্চিম-দক্ষিণ অংশকে আবিমা বলে আখ্যায়িত করে থাকে।
গারো সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এছাড়াও অন্যান্য দেবতা মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়াসহ অনেক দেবতার পূজা পার্বণ করে থাকেন তারা । সাংসারেক রীতি অনুসারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান রীতি নীতি পালন করা হয় গারো সমাজে। এখন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে তাদের আদি সাংসারেক ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে যাচ্ছে।
এক সময় সাংসারেক গারোদের ‘খিম্মা সঙা’ প্রথা ছিল। খিম্মা বা খাম্মা গারো বা আচিক শব্দ এর অর্থ স্মৃতিস্তম্ভ। সঙা হলো পুঁতা। সাংসারেক গারোদের আদি ঐতিহ্য অনুযায়ী কোনেো মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির স্মৃতি রক্ষার্থে এ খিম্মা সঙা করা হতো। কাঠের খোদাই করা খুঁটি দিয়ে খিম্মা দেয়া হতো। খিম্মায় সাংসারেক প্রথা অনুসারে ৫ বা ৭টি খাঁচ রাখা হতো। মৃত ব্যক্তি পুরুষ হলে খিম্মার উপর দিকে জাংগি বা খাচ রাখা হতো। আর নারী হলে নিচের দিকে জাংগি বা খাচ রাখা হতো। খিম্মার উপরের দিকে মাথার মতো রাখা হতো।
খিম্মা পুঁতে রাখা হতো বাড়ির উঠানের সামনের এক কোণে। নারী-পুরুষ ভেদে পালন করা হতো নানাবিধ নিয়মকানুন। নারী হলে নারীদের পোশাক দকশাড়ী, গহনা আর পুরুষ হলে ধুতি, খুতুপ খিম্মায় পরিয়ে রাখা হতো। সাংসারেক আদি ঐতিহ্য মতে, আরও নানা প্রথা নিয়ম মানা হতো। খিম্মা প্রথা গারো আদি ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাচীন প্রথা। ধীরে ধীরে এ খিম্মা বা খাম্মা প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য এলাকায় তেমন দেখা না গেলেও মধুপুর এলাকায় এক সময় অনেক বাড়িতে ছিল। এখন আর আগের মতো নেই। খিম্মা প্রথা কমে যাচ্ছে। মধুপুরের বিভিন্ন গারো পল্লী ঘুরে তাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
মধুপুর আবিমা অঞ্চলের বিভিন্ন গারো পল্লীতে ঘুরে কিছু কিছু বাড়িতে এখনো খিম্মা দেখা যায়। আবার অনেক বাড়িতেই খিম্মা নেই। পাহাড়িয়া এলাকার চুনিয়া গ্রামে সাংসারেক গারো খামাল প্রয়াত জনিক নকরেকের বাড়িতে খিম্মা রয়েছে। তিনি ছিলেন মধুপুর আবিমা অঞ্চলের সাংসারেক গারোদের খামাল বা পুরোহিত। সাইসনামারি গ্রামে প্রয়াত রাগেন্দ্র নকমার বাড়িতেও রয়েছে খিম্মা। শহীদ পীরেনের নামেও বন এলাকার ঝালাবাঁধায় করা হয়েছে খিম্মা। এভাবে সাংসারেক গারোদের আদি ঐতিহ্য কিছু কিছু বাড়িতে দেখা গেলেও এ খিম্মা প্রথাটি অনেক এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে।
গাছাবাড়ি ফাতেমা রানী মিশনারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ঝুমুর আজিম বলেন, আগে তাদের সাংসারেকরা এটা পালন করতো। তিনি খিম্মা সম্পর্কে শুনেছেন এবং খিম্মা স্থাপন করতে দেখেছেন। তবে তিনি নিজে কখনো করেননি।
জিবিসি মিশন বোর্ডে ডিরেক্টর ফাস্টার মধুনাথ সাংমা বলেন, খাম্মা প্রথা তার দাদা-নানীরা করতো। এটা মূলত সাংসারেক গারোদের প্রথা। তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় তাদের ব্যাপ্টিস্ট গারোরা এখন আর খিম্মা বা খাম্মা স্থাপন করেন না।
স্থানীয় গারো কমিউনিটি নেতা ইউজিন নকরেক বলেন, সাংসারেক গারোরা যখন জুম চাষ করতো। তখন পাহাড়ে পাহাড়ে থাকতো। যেখানে যখন জুম ফলাত, সেখানেই থাকতো। তাদের কেউ মারা গেলে পুড়ে ফেলতো। ছাই এনে দাফন করতো। পরে বাড়ির নিকট আত্মীয়, মামা, ভায়রাসহ অন্যদের সাথে নিয়ে শূকর, মদ, মুরগী দিয়ে খিম্মা বা খাম্মা স্থাপন করতো। শূকর, মুরগির রক্ত স্থাপিত খাম্মার উপরে দেয়া হতো, যাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পায়।
তিনি বলেন, এ খাম্মা কাঠ দিয়ে দিতে হয়। সাংসারেক বিশ্বাস মতে, ঐতিহ্যবাহী চু বা মদ আত্মীয়-স্বজনরা খাম্মায় মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য ঢেলে দেয়। শ্রাদ্ধ দেয়ার আগে এ নিয়ম পালন করে থাকে। তার মতে, খাম্মার নিয়ম মতো খরচ করতে না পারা, আধুনিকায়ন, শহরমুখী মনোভাব ও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হবার কারণে এখন অনেকটা কমে যাচ্ছে এই প্রথা। তিনি জানান, বাংলাদেশে একমাত্র মধুপুরে এখনও কোনো কোনো স্থানে খিম্মা টিকে আছে। ভারতেও কিছু আছে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available