কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চাঁদা না দেওয়ায় আলোচিত মিলন হত্যা মামলায় দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন চার আসামি। এ ঘটনায় গ্রেফতার ৬ আসামির মধ্যে দুই আসামির বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ।
৪ ফেব্রুয়ারি রোববার বিকেলে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা সুলতানার আদালতে চারজন স্বীকারোক্তি দেন। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পাশাপাশি ঘটনার বর্ণনাও দেন তারা।
অন্যদিকে গ্রেফতার অপর আসামি কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি এসকে সজিব ও হাউজিং সি ব্লকের ইফতি বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ।
এদিন বিকেল ৫টার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাজু মোহন সাহার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গ্রেফতার ছয় আসামিকে আদালতে হাজির করে। পরে রাত প্রায় সাড়ে ১০টা পর্যন্ত চার আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন আদালত। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাদের কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাজু মোহন সাহা বলেন, মিলন হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার ছয় আসামিকে বিকেলে আদালতে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে লিংকন, জনি, সজল ও ফয়সাল হত্যার দায় স্বীকার করে দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতার অপর দুই আসামি সজিব ও ইফতির বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। বিকেল ৫টা থেকে রাত প্রায় সাড়ে ১০টা পর্যন্ত চার আসামির জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
এর আগে, ৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় অজ্ঞাত ৭/৮ জনকে আসামি করে মামলা করেন নিহত মিলনের মা শেফালী খাতুন।
এরআগে বুধবার সকালে হাউজিং এলাকার সজল মিলনকে মোবাইলে কল করে ডাকে। তার সঙ্গে দেখা করে বাসায় এসে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবার বের হয়ে যায়। তার পরে সে আর ফিরে আসেনি। ওই দিনই মিলনের স্ত্রী মিমি কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার জিডির সূত্র ধরে সজলকে থানায় ডেকে নেয় পুলিশ। এরপর তাঁকে উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কিন্তু সারা দিনেও তিনি কোনো তথ্য দেননি। শুক্রবার সকালে সজল থানায় তাঁর এক পরিচিত পুলিশ সদস্যকে মিলনকে হত্যার কথা জানান।
ওই পুলিশ সদস্যকে আরও জানান, মিলনের ব্যবহৃত মোবাইল জঙ্গলে ফেলে দেন তাঁরা। এরপর বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে পারেন। পরে অভিযান চালিয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে সজীবসহ আরও চারজনকে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সজীবকে আটকের পর তাঁর ফোনে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন নেতা ফোন করেন। তখন ফোনটি পুলিশের হেফাজতে ছিল। আটক ব্যক্তিরা মিলনকে হত্যার কথা অস্বীকার করতে থাকেন। শুক্রবার রাতে সজীব কান্না করতে করতে একপর্যায়ে সব ঘটনা পুলিশকে জানান। এরপর তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে ওইদিন রাত বারোটার দিকে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) পলাশ কান্তি নাথের নেতৃত্বে লাশের টুকরা উদ্ধারে যান অন্তত ৫০ জন পুলিশ সদস্য। সে সময় বেশ কিছু সাংবাদিকরা পুলিশের সাথে ছিলেন। লাশ গুমের পর লাশ টুকরা করতে ব্যবহৃত অস্ত্র বাধবাজার এলাকায় একটি পুকুর থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু জঙ্গলে ফেলে দেওয়া মিলনের ফোন এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। সারারাত কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের দুর্গম চর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে চারটি পৃথক জায়গা থেকে মিলনে নয় খণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
যেভাবে মিলনকে হত্যা করা হয়েছিল:
থানায় জিডির পর থেকে লাশ উদ্ধার ও জড়িতদের ধরার অভিযানে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ। পুলিশের এই কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজন জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানা যায়। গ্রেফতার আসামিদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফোন করে মিলনকে অফিসে ডেকে নেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার সজল। সেখানে আগে থেকে সজীবসহ কয়েকজন অবস্থান নিয়েছিলেন। অফিসে যাওয়ার পর মিলনের কাছে চাঁদা দাবি করেন সজীব। ভয়ভীতি দেখাতে তাঁকে মারধর করেন। একপর্যায়ে মুখে গামছা গুঁজে নাক চেপে ধরেন। ঘটনাচক্রে মিলন মারা যান।
মিলন হত্যাকাণ্ডে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মিলনকে হত্যার সময় ওই অফিসের দুটি কক্ষে সজীবসহ অন্তত ১০ থেকে ১১ জন ছিলেন। সেখানে দুটি কক্ষে তাঁরা অবস্থান নেন। লাশ গুম করতে সজীব পরিকল্পনার কথা জানান তাঁদের। এ সময় একজনকে সঙ্গে নিয়ে অফিসে তালা লাগিয়ে বাইরে চলে যান। বাকিরা ঘরের ভেতর থাকেন। দেড় ঘণ্টা ধরে শহরের তিনটি দোকান থেকে লাশ কাটার জন্য হেক্সা ব্লেড, পলিথিন ব্যাগ ও রক্ত পরিষ্কারের জন্য জীবাণুনাশক কিনেন। বিকেল পাঁচটার দিকে আবার অফিসে ফিরে আসেন। পরে দুর্বলচিত্তের ৪-৫ জনকে পাশের কক্ষে রাখেন। সজীবসহ ৪-৫ জন মিলে একটি কক্ষের বাথরুমে লাশ নিয়ে টুকরা করেন। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে লাশ কেটে তাঁরা ব্যাগে ভরেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে , রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁরা চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসেন। বাকিদের সজীব যে যার মতো বাড়ি চলে যেতে বলেন এবং বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি দেন। পুলিশ শহরের কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা গেছে, রাত ৯টা ৩২ মিনিটের দিকে চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন শহরের ছয়রাস্তা মোড় হয়ে হরিপুর সেতু দিয়ে পদ্মার চরের দিকে চলে যান। রাত ১১টার মধ্যে লাশের টুকরাগুলো পদ্মার চরে বালুচাপা দিয়ে যে যার মতো বাড়ি চলে আসেন। সবাই স্বাভাবিকভাবে শহরে চলাফেলা করতে থাকেন। কেউ পালানোর চেষ্টা করেননি।
এস কে সজীবের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শহরে একটি গ্যাং চলে। তার নেতৃত্বে মিলন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যা করার পর লাশ গুম করা উদ্দেশ্যে নয় টুকরো করার পরেও এস কে সজীব শহরেই স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের সঙ্গে কুষ্টিয়া পলিটেকনিকে একসঙ্গে ছিলেন।
মিলন হোসেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাহিরমাদি গ্রামের মাওলা বক্স সরদারের ছেলে। তিনি স্ত্রী মিমি খাতুনকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং ই ব্লকে ভাড়া বাসায় থাকতেন। টেক্সটাইল প্রকৌশলে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available