বাবুল আকতার, খুলনা ব্যুরো: খুলনার কয়রা উপজেলার আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সাবেক মাঝি আবু বক্কর কাস্টমস কর্মকর্তা সেঁজে জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ শিকারসহ বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষকে অত্যাচার ও হয়রানী করে গত একযুগ ধরে অপরাধ কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে।
‘কাস্টমসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পুলিশ, কোস্টগার্ড, ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বনরক্ষীদের ম্যানেজ করে এবং স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব খাটিয়ে বক্কর মাঝি হয়ে উঠেছেন অপরাধ জগতের গডফাদার আবু বক্কর সাহেব। এসব অপরাধ করে গত একযুগেরও বেশী সময়ে কয়েক’শো কোটি টাকা ও জমিজমা-ফ্লাট বাড়িসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে বক্কর মাঝি। তার বিরুদ্ধে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করলে বক্কর তার নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে প্রতিবাদকারীর বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মাদক, হরিণের মাংস ও অস্ত্র রেখে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে শায়েস্তা করে থাকে’ বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদেরকেও বাদ রাখেনি বক্কর বাহিনী। আবু বক্করের অপরাধ সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে তার ভাই আলমগীর গাজী, তানভীর গাজী, ভাগ্নে আলমগীর হোসেন, অলিউর রহমান বাবু, তৈয়বুর গাজী অন্যতম। গত দু’সপ্তাহে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন আংটিহারা এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে ঘাট মাঝি আবু বক্করের অপরাধ কর্মকাণ্ডের এসব চিত্র উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামের মৃত আমিন গাজীর ছেলে আবু বক্কর গাজী। ২০১২ সালে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের ট্রলার মাঝি হিসেবে যোগদান করেন। গত এক যুগ ধরে সেখানেই কর্মরত থেকে বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াতকারী জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ পাচারসহ গড়ে তুলেছে অপরাধের বিশাল সাম্রাজ্য। বাংলাদেশ-ভারত নদীপথের সীমান্তবর্তী আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অঘোষিত সম্রাট হয়ে উঠেছে মাঝি আবু বক্কর। এজন্য রয়েছে বক্করের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। যাদের মাধ্যমে স্থানীয় সাধারণ মানুষকে অত্যাচার, ভয়ভীতি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানী করে গত একযুগ ধরে অপরাধ কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে তার উপর সন্ত্রাসী হামলা, মাদক ও হরিনের মাংস রেখে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অতিসম্প্রতি আবু বক্করের অপরাধের বিষয়ে প্রতিবাদ করায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা ও রুহুল আমীন গাজী নামে দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে হরিণের মাংস রেখে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। যার অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এর সূত্র ধরে বক্করের অপরাধ জগতের নানা চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ঘাট মাঝি আবু বক্কর কাস্টমসের অফিসিয়াল ড্রেস পরে কখনও নিজেকে কাস্টমসের অফিস সহায়ক আবার কখনও কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। এভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভুয়া পরিচয় দিয়ে বক্কর গত ১২বছর ধরে প্রতারণা, অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অপরাধ করে যাচ্ছে। মাঝি বক্কর তার অপরাধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক চোরাচালান, জাহাজের তেল চুরি, চাঁদাবাজি, সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার করে পাচারসহ এলাকায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে অর্ধ কোটি টাকারও বেশী হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ঠরা।
সম্প্রতি আবু বক্করের অপরাধ সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগী স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের গণস্বাক্ষরিত অভিযোগ স্থানীয় সংসদ সদস্য, খুলনা বিভাগীয় কাস্টমস কমিশনার ও সরকরি বিভিন্ন দফতরে দাখিল করেছেন। লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, ভুক্তভোগী লক্ষণ মুন্ডা স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সুন্দরবন কমিউনিটি পেট্রোলিং টিমের সদস্য। তিনি এক সময় শুল্ক স্টেশনের মাঝি হিসেবে অস্থায়ীভাবে কাজ করতেন। স্থায়ী নিয়োগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আবু বক্কর তার কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আবু বক্করের বিরদ্ধে হরিণ শিকার, জাহাজের তেল চুরি ও মাদক পাচারের বিষয়ে মুখ খোলায় লক্ষণ মুন্ডার অস্থায়ী নিয়োগ বাতিল করা হয়। পরে বক্করের কাছে টাকা ফেরৎ চাইলে লক্ষণ মুন্ডার আত্মীয় ভৈরব রায়কে হরিণের মাংস দিয়ে ফাঁসিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয় বক্কর বাহিনী।
ভুক্তভোগী লক্ষণ মুন্ডা অভিযোগে আরও জানান, ভারত থেকে সিমেন্টের কাঁচামালবাহী জাহাজে কর্মরতদের ম্যানেজ করে ফেন্সিডিল, মদ, গাজা ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসে আবু বক্কর। সে অফিসের স্টাফ না হয়েও নিজেকে অফিস সহায়ক ও অফিসার পরিচয় দিয়ে কাস্টমসের পোষাক পরে অফিসের সকল কাজ করে থাকে। সে কারনে প্রভাব খাটিয়ে মাদক পাচারের রুট নিয়ন্ত্রণের জন্য সে অনেক সময় কর্মস্থলের বাইরে গিয়ে অবস্থান করে। ভারত থেকে মাদক এনে তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে এসব মাদক। আবু বক্করের অপরাধ সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে তার ভাই আলমগীর গাজী, তানভীর গাজী, ভাগ্নে আলমগীর হোসেন, অলিউর রহমান বাবু, তৈয়বুর গাজী অন্যতম। এদেরকে দিয়ে জাহাজে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের বাঘ-হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করে থাকে। এছাড়া আংটিহারা কাষ্টমস শুল্ক স্টেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে বক্কর অফিসের দাপ্তরিক যাবতীয় কাজও করে থাকে। সেকারণে জাহাজের নাবিক ও মাস্টারসহ আংটিহারা নৌরুটে চলাচলকারী বাংলাদেশ-ভারতের জাহাজের সবকিছুই তার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। বক্কর প্রভাবশালীদের মদ, অর্থ ও হরিণের মাংসসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে খুশি রেখে তার অপরাধ কর্মকাণ্ড এখনও নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ-ভারত নৌ ট্রানজিট প্রোটকলের আওতায় প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৮০ থেকে ১০০টি ভারতীয় জাহাজ আংটিহারা নৌরুটে যাতায়াত করে। প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ থেকে ৪০-৫০ লিটার ডিজেল জোরপূর্বক আদায় করে বক্কর সিন্ডিকেট। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। আংটিহারা কাস্টমসের ক্লিয়ারেন্স নেয়ার জন্য প্রতিটি জাহাজ মাঝি বক্করের বেধে দেয়া সময়ের চেয়ে বেশী সময় নোঙর করলে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক জরিমানা আদায় করে বক্কর বাহিনী। এভাবে প্রতিমাসে বক্কর সিন্ডিকেট জরিমানা বাবদ প্রায় ৩লাখ টাকা আদায় করে। এছাড়া কাস্টমস অফিস থেকে ছাড়পত্র নিতে প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ থেকে ১০হাজার টাকা হিসাবে প্রতিমাসে ১০০টি জাহাজ থেকে ১০লাখ টাকা আদায় করে।একই সাথে ভারতীয় জাহাজে চাউল, গম, ভুট্টা, ভূষি এবং লোহার গুড়া থাকলে প্রতিটি জাহাজ থেকে অতিরিক্ত ১০হাজার টাকা হিসাবে প্রতিমাসে ৩থেকে ৫লাখ টাকা আদায় করে থাকে। আগত প্রতিটি জাহাজে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদানের জন্য কাস্টমস অফিসে আসা-যাওয়া বাবদ এক হাজার টাকা হিসাবে প্রতি মাসে ৬থেকে ৭লাখ টাকা আদায় করে বক্কর সিন্ডিকেট। প্রত্যেকটি বাংলাদেশী ও ভারতীয় জাহাজ কাস্টমস অফিসের ইনস্পেকশান করতে অফিসিয়াল খরচ বাবদ ২হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা বক্কার গাজী জোর করে নিয়ে থাকে। এ বাবদ সে প্রতিমাসে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা আদায় করে। এছাড়া পানি সরবরাহ না করে বিআইডব্লিউটিএ-এর পাইলটদের পানির খরচ বাবদ বিআইডব্লিউটিএ-এর অপারেটর মনোহরের মাধ্যমে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা আদায় করে। মাঝি আবু বক্কর জাহাজের ড্রাইভার ও মিস্ত্রীদের সাথে যোগসাজসে অবৈধভাবে জাহাজের জ্বালানী তেল ক্রয়-বিক্রয় করে প্রতি মাসে আরও ৩ থেকে ৪ লাখ টাকারও বেশী হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবে মাঝি বক্কর তার সিন্ডিকেট ও নিজস্ব দস্যু বাহিনীর মাধ্যমে গত ১২ বছরে কয়েক শো’ কোটি টাকা ও জমিজমা-ফ্লাট বাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মাঝি আবু বক্কর তার অবৈধ আয় থেকে খুলনার রুপসা ব্রীজের পশ্চিম পাড়ে ৩৪ লক্ষ টাকায় বিলান জমি, খুলনার সোনাডাঙ্গা ২নং আবাসিক এলাকায় ৫৭ লাখ টাকা মূল্যের ১টি ফ্ল্যাট ও কেডিএ’র নতুন ময়ূরী আবাসিক এলাকায় ৯৫ লক্ষ টাকা মূল্যের ১টি প্লট ক্রয় করেছে। এছাড়া দৌলতপুরের মহসীন রোড সংলগ্ন চৌরাস্তা মোড়ে ২ কাঠা জমির উপর আনুমানিক ৬০ লক্ষ টাকা মূল্যের ২ তলা পাকা ভবনও রয়েছে মাঝি বক্করের। খুলনা শহরে বক্করের মালিকানাধীন ১৬ লক্ষ টাকা মূল্যের ২টি সিএনজি ভাড়া দেওয়া রয়েছে। খুলনা নগরীর বড় বাজারে তার জামাই কামাল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব সম্পদ মাঝি বক্কর অপরাধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্জিত আয় দিয়ে কিনেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাঝি বক্করের দুই ভাই হাবিবুর রহমান ও দিদারুল আলম গাজী জানান, আবু বক্করের তেমন কোন জায়গা জমি ও সম্পদ ছিল না। সে বসবাস করতো সরকারী খাস জমিতে। কাস্টম অফিসে মাঝি হিসেবে যোগদানের পর থেকে তার অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। সে নিজেকে কাস্টমস অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অফিসিয়াল ড্রেস পরে ভারত থেকে আগত জাহাজের নাবিকদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তেল ও মাদক পাচার, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ঘাটের মাঝিদের ব্যবহার করে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ড করে। একই সাথে নিজস্ব বাহিনী ও সিন্ডিকেট গড়ে অবৈধভাবে বিপুল পরিমান অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে। তার অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থে সে খুলনাসহ বিভিন্ন জায়গায় জমিজমা, বাড়ী ও ট্রলার কিনেছে। তার অত্যাচারে এলকার মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। আমরা তার এ অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপরাধ কর্মকাণ্ডের যথাযথ বিচার দাবী করছি।
ভুক্তভোগী আংটিহারা কাস্টমস ঘাটের মাঝি দীলিপ মন্ডল ও আব্দুল লতিফ ও স্থানীয় দোকানদার ফারুক হোসেন জানান, আবু বক্কর এখন কাস্টমসে কোন চাকুরি করে না। কিন্তু সে বিপুল পরিমান সম্পদের মালিক। সে মাঝি হিসেবে চাকরি করলেও অল্প সময়ে এতো সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব না। এলাকায় তার অথ্যাচার-নির্যাতন ও অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও তাকে সমীহ করে চলে। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, বাঘ-হরিণ শিকার ও জমি দখলের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবন টেন্ডার ছাড়া ভেঙ্গে নিজেই বাড়ির নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেছে। সে স্থানীয় মাঝি সমিতিরও লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে গেলে বক্কর তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা, মামলা এবং মাদক ও হরিণের মাংস দিয়ে ফাঁসিয়ে জব্দ করে থাকে। তার এধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সঠিক বিচার দাবী করেন স্থানীয় মাঝিরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আংটিহারা কাস্টমস শুল্ক স্টেশনে আগত বাংলাদেশ ও ভারতীয় জাহাজের একাধিক মাস্টার ও নাবিক জানান, আমরা এক প্রকার আবু বক্করের কাছে জিম্মি। কারণ সে কাস্টমস অফিসের সকল কাজ করে থাকে। সে সামান্য অজুহাতে সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয় দেখিয়ে আমাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক তেল ও অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। অনেক সময় তার কথা মত বিভিন্ন অবৈধ জিনিস আনতে বাধ্য না হলে আবু বক্করের দ্বারা বিভিন্ন রকম হয়রানীর শিকার হতে হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এ প্রতিবেদককে মাঝি আবু বক্কর বলেন, তার বিরুদ্ধে স্থানীয় একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া অভিযোগ করছে। বিশেষ করে তার নিজের দুই ভাই প্রতিপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে এ ধরণের কাজ করছে বলে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন। মূলত আমি এখানে থাকলে প্রতিপক্ষরা অপকর্ম করার সুযোগ পায় না। সে কারণে এসব বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। তিনি আরো জানান, আমি মাঝি ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম বর্তমানে সে দায়িত্বেও নেই৷ জাহাজে করে মাদক এনে এবং সুন্দরবনের হরিণ শিকার করে তা পাচার করাসহ অন্যদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়ও তিনি অস্বীকার করেন। তবে তার কাজের সহযোগীতার জন্য স্থানীয় সাবেক এমপি, কয়রা থানা পুলিশ, আংটিহারা নৌ পুলিশ, কাস্টমস অফিস, ইমিগ্রেশন অফিস, বন বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, প্রে সক্লাবের কিছু সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়মিত মাসিক উৎকোচ দিয়ে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন বলে একটি তালিকা এ প্রতিবেদকের কাছে উপস্থাপন করেন। যে তালিকায় কোন কোন ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদেরকে কি পরিমাণ অর্থ প্রতিমাসে প্রদান করা হয়েছে, সেটিও উল্লেখ রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
কয়রার আংটিহারা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মাহমুদ হোসেন জানান, আবু বক্কর মাঝি অর্থ প্রদানের যে কথা বলেছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এখানে মাঝিদের দুটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ করে চলেছে। এখানে কাজ করতে আমাদের সাথে সব পক্ষেরই যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। সেভাবেই কাস্টমসের সাবেক মাঝি হিসেবে আবু বক্করের সাথেও যোগাযোগ রয়েছে। তবে কোন অনিয়মের বা দূর্নীতির সহায়তা তাকে করেন না বলে তিনি জানান।
আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি মাত্র ৪-৫ দিন হয় এ স্টেশনে যোগদান করেছি। এসে যতটুকু জেনেছি মাঝি বক্কর কাস্টমসের নিয়োগকৃত কোন কর্মচারী নয়। সে স্থানীয় ট্রলারের মাঝি হিসাবে জাহাজের লোকজনকে আনা নেওয়ার কাজ করে। মাঝি হয়েও কাস্টমসের পোশাক পরে কিভাবে অফিসের সকল কাজ করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি এসে তাকে এখানে সেভাবে কাজ করতে দেখছি না। এছাড়া তার চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের অপরাধের বিষয়ে জানা নেই বলে জানান তিনি।
খুলনা কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে আংটিহারা কাস্টমস স্টেশনের সাবেক মাঝি আবু বক্করের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়ে আঞ্চলিক অফিস (আরও) সুপার লুৎফর রহমান গাজীকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। অচিরেই কমিটি তাদের তদন্ত শুরু করবে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই সাথে মাঝি বক্কর যেন কোনভাবেই আংটিহারা কাস্টমস অফিসে ঢুকতে না পারে সে বিষয়ে স্টেশনে কর্মরত কর্মকর্তা হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরীকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কাস্টমসের পরিত্যক্ত ভবনের নিচতলায় দুটি রুমে বক্করের রাখা চোরাচালানের তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সরানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান জানান, আংটিহারা কাস্টমস ষ্টেশনের সাবেক মাঝি আবু বক্কর গাজীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তবে তার অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে ইতোপূর্বে তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় ৪-৫ বছর আগে মাঝির কাজ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দুর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ইতোমধ্যেই অফিসের বাউন্ডারির পকেট গেট বন্ধসহ বক্করকে কাস্টমস অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে তিনি জানান।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available