বাগেরহাট প্রতিনিধি: হাতে ভাজা মুড়ি হলো বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য। বছরজুড়ে কমবেশি এই মুড়ির কদর থাকলেও রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যেতো কয়েকগুণ। বর্তমানে মানুষের আধুনিক জীবনযাত্রায় শহর থেকে গ্রামাঞ্চলেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সেই ছোঁয়ায় আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছে মুড়ি তৈরির ধরন। যান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বাগেরহাটের মোংলায় হাতে ভাজা মুড়ি যেন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। হাতে ভাজা মুড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে কারখানার মেশিনের তৈরি মুড়ি।
একটা সময় ছিল গ্রামাঞ্চলের গৃহবধূরা মৌসুমী ধান কাটার পর মুড়ি ভাজার জন্য আলাদা করে ধান রাখতেন। সেই ধান রোদে শুকানোর পর ভাঙিয়ে চাল তৈরি করে নিজ হাতে মুড়ি ভাজতেন। অনেকে আবার ভালো চাল কিনে মুড়ি ভাজতেন। প্রতিটি ঘরে ছিল হাতে ভাজা মুড়ি তৈরির প্রচলন। গ্রামের ছোট-বড় যে কোনো পরিবারে সারা বছরই হাতে ভাজা মুড়ি পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে অনেক পরিবারের লোকজন হাতে তৈরি মুড়ি ভেজে বিক্রি করে উপার্জন করতেন। আর রমজান মাসে ছিল তাদের মুড়ির বাড়তি কদর।
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামাঞ্চলে হাতে তৈরি ভাজা মুড়ি তেমন একটা চোখে পড়ছে না। দেশের বড় বড় নামি-দামি কোম্পানিগুলো মুড়ি তৈরি করে অতিসহজে শহর থেকে শুরু করে গ্রামের দোকানগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে।
গত কয়েক বছর আগেও মোংলা পৌর শহর ও মোংলার মিঠাখালী ইউনিয়ন'সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হাতে তৈরি ভাজা মুড়ি তৈরি করতেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে যান্ত্রিক কারখানায় তৈরি মুড়ি বাজার দখল করে নেয়ায় অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে মুড়ি ভাজা ছেড়ে দেওয়া রতন মন্ডল বলেন, এক সময় বছরজুড়ে বাড়িতে হাতের ভাজা মুড়ি তৈরি করা হতো। পরিবারের সবাই কমবেশি শ্রম দিতো। স্থানীয়দের পাশাপাশি পাইকাররা এসে বাড়ি থেকে মুড়ি নিয়ে যেতো। বর্তমানে চাল, লাকড়িসহ আনুসাঙ্গিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় লাভ তেমন হয় না। তাছাড়া মেশিনের তৈরি মুড়ি অতি সহজে বিভিন্ন দোকানে পাওয়ায় হাতে তৈরি মুড়ির চাহিদা অনেক কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আসলে হাতে তৈরি মুড়ির রং লালচে হলেও খেতে সুস্বাদু হয়। এই মুড়ি দীর্ঘ দিন ঘরে রাখলেও এর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। কারখানায় মুড়ি দেখতে সাদা ধবধবে হলেও দুই দিন ঘরে রাখলেই চুপসে যায়। এসব মুড়ি খোলা অবস্থায় প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হওয়ায় সব জায়গাতে চাহিদা বেড়েছে। এতে করে হাতে তৈরি মুড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে মোংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়নের মুড়ি তৈরির কারিগর অরুণ মন্ডল বলেন, ৪০ বছর ধরে নিজের হাতে মুড়ি ভেজে বিক্রি করছি। এক সময় এ পাড়াসহ অন্য জায়গাতে অনেক লোকজন হাতে মুড়ি তৈরির কাজে জড়িত ছিল। বর্তমানে নানা প্রতিকূলতায় অনেকেই মুড়ি তৈরি কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য কোনো কাজ জানা না থাকায় এ পেশায় কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় বাজারে হাতে ভাজা প্রতি কেজি মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। রমজান মাস আসায় চাহিদা বেড়েছে। দৈনিক ৩০ কেজি চালের মুড়ি ভাজা হয়। মুড়ি ভেজে স্থানীয় দোকান ও পাইকারদের কাছে বিক্রি করছি।
এ বিষয়ে মোংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়নের লিটন মন্ডল, অরুপ চৌধুরী ও মিঠুন মলঙ্গীর বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি বাড়িতে মা-চাচিরা জমির ধান থেকে মুড়ি ভাজার চাল তৈরি করে মুড়ি ভাজতেন। সব সময় প্রত্যেক ঘরে কমবেশি ভাজা মুড়ি পাওয়া যেতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষ আর হাতে মুড়ি তৈরি করছে না। মেশিনের তৈরি মুড়ি দোকান থেকে মানুষ ক্রয় করছেন। যার কারণে হাতে ভাজা মুড়ির ঐতিহ্য আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে মোংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়নের মুড়ি ক্রেতা বিকাশ মন্ডল (গুরু) বলেন, আসলে সব সময় চেষ্টা করি দেশীয় হাতের তৈরি মুড়ি খাওয়ার জন্য। এখনতো সব জায়গাতে হাতে তৈরি মুড়ি পাওয়া যায় না। তাই মেশিনের তৈরি মুড়ি কেনা হয়।
এ বিষয়ে মোংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়নের স্থানীয় ডা. হাকিম বিপ্লব সরদার বলেন, এক সময় ঘরে ঘরে মুড়ি ভেজে খাওয়ার প্রচলন থাকলেও তা এখন নেই। বর্তমানে হাতে তৈরি মুড়ির চাইতে মেশিনে ভাজা মুড়ির চাহিদা বেশি। দামও কম। তবে পরামর্শ থাকবে মেশিনে ভাজা মুড়ি না খাওয়াই ভালো। কারণ, এটা স্বস্থ্যসম্মত নয়।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available