বাবুল আকতার, খুলনা ব্যুরো: আজ সেই ভয়াবহ ২৫ মে। ২০০৯ সালের এই দিনে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আইলা ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে লোনা পানিতে তলিয়ে যায় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূল। লণ্ডভণ্ড হয় সুন্দরবন, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ উপকূলীয় বেশ কিছু উপজেলা। সবুজ, শস্য-শ্যামলে ভরা এ জনপদ স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রাণহানি ঘটে প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষের। ঘর-বাড়ি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালভার্ট, মাছ-ফসল, গাছ-পালা, গৃহ-পালিত প্রাণিসহ ভেসে যায় মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র।
আজ থেকে ১৫ বছর আগে দক্ষিণ-পশ্চিমা লের উপকূলবাসীর জন্য এ দিনটি ছিল অভিশপ্ত এক দিন। এই দিনটির কথা মনে করলে আজও ভয়ে শিউরে ওঠে উপকূলবাসী। স্বজন হারানোদের মনে করিয়ে দেয় তাদের প্রিয়জনের মুখখানি। মাটি দেয়ার জায়গা অভাবে অনেকের মরদেহ ভাসিয়ে দিতে হয়েছে সাগরে। দেখতে দেখতে আইলার ১৫ বছর পার হলেও এখনও ক্ষতিগ্রস্থ বহু পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে ১৫ বছর ধরে দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে আজও টিকে আছে এ অঞ্চলের অসহায় মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারের ভেড়িবাঁধের উপরেই এখনও রাত কাটছে ।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের পাউবোর বেড়িবাঁধের ওপর এখনও অনেক মানুষ সেই থেকে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করে আসছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে শত কষ্টের মধ্যে দিয়ে বেড়িবাঁধকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তারা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সহায় সম্পদ বলতে যা কিছু ছিল তার সবটুকু জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাছাড়া ওই সময়কার নদীর প্রবল ভাঙনে শাকবাড়িয়া, কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষের বসতভিটা, আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গাছপালা শূন্য কয়রা উপজেলার পরিবেশ এখনও ফিরে পায়নি তার পূর্বের রূপ। যে কারণে শুকনা মৌসুমে প্রচন্ড তাপদাহে মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। লবণাক্ততার কারণে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে কৃষকরা আজো ঠিকমতো ফসল ফলাতে পারছে না।
তবে স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, অত্র এলাকায় কৃষকরা আইলার পর থেকে বিগত কয়েক বছর ধরে বেশকিছু জমিতে ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এখনও লবণাক্ততার গ্রাস থেকে পূর্ণাঙ্গ রক্ষা পায়নি সমগ্র কয়রা এলাকা। ভেঙে যাওয়া ভয়াবহ পবনা বাঁধ, হারেজখালি, পদ্মপুকুর, শিকারিবাড়ি, পাথরখালি মেরামত হলেও কয়রার ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত মাটি নেই। দীর্ঘদিন ধরে এসব বেড়িবাঁধে পাউবো কর্তৃপক্ষ মাটি না দেয়ায় বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙা উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রার পুরাতন ল ঘাট সংলগ্ন এলাকা, ঘাটাখালি, হরিনখোলা, মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকার বেড়িবাঁধগুলো অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ সকল বেড়িবাঁধ সংস্কার করা না হলে যে কোন মুহূর্তে ভেঙে আবোরো গোটা উপজেলা লোনা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।
ইতোমধ্যে গাজী পাড়া বাঁধ ভেঙে বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাছাড়া কাটকাটার অবস্থা ভয়াভয়। এ ছাড়া কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চ ঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলো মিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় দুই কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশির হাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় তিন কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে গোটা জনপদে মানুষের কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাড়ি জমালেও ১৫ বছর পরও তাদের অনেকে এখনও বাস্তভিটায় ফিরতে পারেননি। আইলার ধ্বংস লীলায় ক্ষতিগ্রস্ত কয়রার মানুষের দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধ টেকসই না হলে আগামী দিনগুলোতে এ অঞ্চলে তাদের বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আইলার জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে এখানকার মানুষ খাবার পানির উৎস হারিয়ে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার করছে। অনেক জায়গার অসহায় মানুষ ১০/১২ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছে। ওইসব এলাকায় পরিকল্পনা মাফিক গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুকুর সংস্কার করে পিএসএফ স্থাপন করা গেলে খাবার পানির সংকট থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে বলে অভিমত স্থানীয়দের।
আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশকিছু এখনও সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ অঞ্চলের তিন লক্ষাধিক মানুষের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়। উপজেলার অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটগুলো এখনো পুরোপুরি সংস্কার না হওয়ায় অনেকের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ঝড় থেমেছে দীর্ঘ ১৫ বছর আগে, কিন্তু অনেকের কান্না থামেনি এখনও। আইলার তান্ডবে বিধ্বস্ত খুলনার দাকোপ উপকূলের মানুষের পাশে কেউ নেই। বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য হাহাকার করছে উপজেলার দেড়লক্ষাধিক মানুষ। আইলা দুর্গত এলাকার গ্রামে গ্রামে চলছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবারের বসত ভিটা নদী গর্ভে হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। ওই সকল পরিবারের অনেকেই এলাকা ছেড়ে গেছেন, অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁধে আশ্রয় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। খুলনার উপকূলীয় দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
সুতারখালী ইউনিয়নের গুনারী গ্রামের তৈয়বুর রহমান, ফজলুল গাজী, কালিপদ সানা, মহিবুর মীর কামারখোলা ইউনিয়নের ফকিরডাঙ্গা গ্রামের অবনী রায়, প্রহলাদ মন্ডল, বিনোদ বিহারী রায়, শফিকুল ঢালী জানান, আইলার পরবর্তী সময় অনেক জনপ্রতিনিধির পদচারণা দেখা গেছে এবং তারা আমাদের পুনর্বাসন করার জন্য অনেক প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। কিন্তু এখন তাদের আর দেখা যায় না। বর্তমানে এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। এলাকায় খাবার পানির উৎস যে সকল পুকুর ছিলো সেগুলি সবই প্রায় শুকিয়ে গেছে। কোথাও খাবার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ভাত না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু একটু খানি পানির তৃষ্ণা মিটাবার জন্য এলাকায় চলছে হাহাকার। আমরা দুর্গতরা ভাত কাপড় চাই না, আমরা খাবার পানি চাই।
সুতারখালী ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, এই ইউনিয়নে প্রতিদিন এক লাখ লিটার খাবার পানির প্রয়োজন। প্রতিটি গ্রামে খাবার পানির জন্য হাহাকার চলছে। এখন পর্যন্ত এ ইউনিয়নের অনেক পরিবার অভাবের কারণে বসতঘর নিমার্ণ করতে না পারায় তারা খোলা আকাশের নিচে ওয়াপদা বেড়িবাঁধের উপর মানবেতর জীবন যাপন করছে।
এদিকে সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমেল মোকাবেলায় পাউবো কর্তৃপক্ষ ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে । এ মুহূর্তে কয়রার প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কোথাও কোথাও দেড় থেকে দুই হাত মাটি অবশিষ্ট রয়েছে। বাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে বড় জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। বেড়িবাঁধের দুর্বল স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে উপজেলার ১৩-১৪/২ নং পোল্ডারের হরিণখোলা ও ঘাটাখালি এলাকার ১৭০০ মিটার, উত্তর বেদকাশির কাঠমার চর ১০০ মিটার, হোগলা ৪০ মিটার, দশালিয়া থেকে হোগলা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এসব এলাকার বেড়িবাঁধ খুবই নিচু হয়ে গেছে, যেকোনো দুর্যোগ এলেই পানি উপচে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছ।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানায়, গত এক দশকে মে মাসে সাতটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াসে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ কারণে চলতি মে মাসেই আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে আতঙ্কিত কয়রার মানুষ।
কয়রা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোস্তফা শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রার প্রধান সমস্যা নদী ভাঙন। এটি রোধ করা গেলে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জরুরি ভিত্তিতে দেখা দরকার।
খুলনা পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মশিউল আবেদীন বলেন, কয়রার বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোর কাজ করা হবে। তাছাড়া যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা সর্বক্ষণ প্রস্তুত আছি।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available