মো. কামরুজ্জামান, বাগেরহাট: দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টা সুন্দরবনের উপর তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সুন্দরবন। ২৮ মে মঙ্গলবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩৯টি হরিণ ও ১টি বন্য শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এছাড়া ১৭টি হরিণকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শুশ্রুষার পর বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
প্রাথমিক অবস্থায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে ৬ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষণ (সিএফ) মিহির কুমার দো এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সুন্দরবনের কটকা, কচিখালি, দুবলা, বুড়ি গোয়ালিনী, কোকিল মনি, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া ফরেস্ট ক্যাম্পসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ও সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এটি এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম জানান, দীর্ঘ সময় সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকার জলমগ্ন থাকায় অনেক বন্য প্রাণীর হতহতের ঘটনা ঘটেছে। বন্যপ্রাণীর জন্য খনন করা সুপেয় পানির পুকুরও ভেসে গেছে। বনবিভাগের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা ওয়ারলেস এখনো সচল হয়নি। তবে বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্টেশনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরা নিরাপদে রয়েছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কাজ চলছে। বন বিভাগের লোকজন সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় কয়েকটি হরিণকে ঝড়ের সময় ভেসে যেতে দেখেছে। দীর্ঘ সময় ঝড়ের প্রভাব থাকায় ভাটার সময়ও জোয়ারের পানি না কমায় সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকা জলমগ্ন ছিল প্রায় ৩০ ঘণ্টা। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে পরবর্তী ঝড় ঝঞ্জা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে এবং বন্যপ্রাণী প্রাণহানির কমাতে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অসংখ্য উঁচু মাটির কেল্লা নির্মাণসহ বাস্তবমুখী অনেক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
দীর্ঘদিন সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী সেফ দা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বাঘ বা হরিণ জাতীয় বন্যপ্রাণী ৬ ঘণ্টার বেশি পানির মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশের টিকে থাকতে পারে না। বিগত সময়ে সুন্দরবনের যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে তার স্থায়িত্বকাল ছিল খুব কম। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ছিল ব্যতিক্রম। ৩০ ঘণ্টার উপরে ঝড়ের প্রভাব থাকায় সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা দীর্ঘ সময় জনমগ্ন ছিল। ভাটার সময়ও এবার পানি কমেনি। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকতে পারে। বনবিভাগের উচিত বাঘ-হরিণের মৃতের সঠিক তথ্য তুলে ধরে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি জলোচ্ছ্বাস ও জলমগ্নতা থেকে বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় নতুন করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. খালিদ হোসেন জানান, ১০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ৩৫ হাজার বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অসংখ্য গাছপালা উঠে পড়েছে। শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ, মোংলায় বেশ কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয় প্রবেশ করায় অনেক এলাকা জনমগ্ন রয়েছে। ২৮ মে মঙ্গলবার সকালে পানি কমতে থাকায় উপকূলের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষ তাদের বাড়িঘরে ফিরেছে।
মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে, বাগেরহাটের প্রায় ৩৫ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল। রামপাল, মোংলা, মোড়লগঞ্জ, বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় মৎস্য চাষিদের তুলনামূলক বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে মৎস্য চাষিদের হিসাবে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের শরণখোলায় গাছ চাপা পড়ে মোসা. ফজিলা বেগম (৫৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ২৭ মে সোমবার দুপুরের আগ মুহুর্তে উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২৮ মে মঙ্গলবার ৫টা ৫৩ মিনিটে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।
নিহত মোসা. ফজিলা বেগম খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামের হাফেজ মো. রুহুল আমিনের স্ত্রী। তাদের কোনো সন্তান নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনে এখানে থাকতেন। মঙ্গলবার সকালে নিজ বাড়িতে এই নারীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, ওই নারী সোমবার মারা গেছেন। কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টি, বিদ্যুৎ ও মুঠোফোন নেটওয়ার্ক না থাকায় মঙ্গলবার বিকেলে আমরা জানতে পেরেছি। তার নাম ঠিকানা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন জানান, সোমবার দুপুরের আগমুহুর্তে ওই নারী রান্না করছিলেন। তখন রান্না ঘরের উপর গাছ পড়ে, ঘটনাস্থলেই ওই নারীর মৃত্যু হয়। তার স্বামীও বেশ অসুস্থ বিষয়টি এলাকাবাসী অনেক পড়ে জানতে পারে। রাতে স্থানীয় লোকজন নিয়ে গাছ সরিয়ে ওই নারীর মৃতদেহ বের করা হয়। মঙ্গলবার সকালে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রচন্ড বৃষ্টি, বাতাস, মোবাইলে চার্জ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় বিষয়টি প্রশাসনকে জানাতে দেরি হয়েছে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদিপ্ত কুমার সিংহ বলেন, শরণখোলায় প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টি ছিল। বিদ্যুৎও ছিল না। তাই আমরা বিষয়টি জানতে পারিনি। মঙ্গলবার দুপুরের পর ওই এলাকার চেয়ারম্যান উপজেলায় এসে তার মৃত্যুর বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available