রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় ধার নেওয়া ২০ হাজার টাকা দিতে না পারায় এক গৃহবধূকে দুই মাস ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। বিচার চেয়ে না পেয়ে ওই গৃহবধূ ও তার স্বামী বিষপান করেছেন। এতে গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ অবস্থায় স্বামী বিছানায় কাতরাচ্ছেন।
গত ২৪ মে শুক্রবার ওই দম্পতি বিষপান করেন। পাঁচ দিন ধরে ‘বিষক্রিয়ার’ সঙ্গে লড়াই শেষে ২৯ মে বুধবার দুপুরে গৃহবধূর মৃত্যু হয়। উপজেলার সদর ইউনিয়নের কলেজপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ওই দম্পতির তিন বছরের এক শিশুসন্তান রয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলো উপজেলার সদর ইউনিয়নের হলপাড়া গ্রামের আবুসামার ছেলে জয়নাল মিয়া এবং তার সহযোগী কারিগরপাড়ার শুক্কুর কসাই, ডাকাতপাড়ার আলম কসাই ও টাঙ্গাইলপাড়ার সোলেমান।
মৃত্যুর আগে ২২ মে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে দেওয়া গৃহবধূর জবানবন্দির একটি অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। এতে পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বর্ণনায় উঠে এসেছে কীভাবে জয়নাল ও সহযোগীরা মাসের পর মাস তাকে ধর্ষণ করেছে।
বর্ণনায় গৃহবধূ বলেছেন, ‘আমার বাবা নেই। মা গৃহকর্মীর কাজে বিদেশে থাকেন। স্বামী টাঙ্গাইলে শ্রমিকের কাজ করেন। স্বামীর ধারের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় জয়নাল গত রমজান মাসের শুরু থেকে ধর্ষণ শুরু করে। পরে তার সহযোগী আলম কসাই, শুক্কুর কসাই ও সোলেমান দিনের পর দিন পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে তাদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে বাধ্য হয়ে স্বামীকে বিস্তারিত ঘটনাটি জানাই। পরে স্থানীয় মাতব্বরদের কাছে অভিযোগ দিয়েও বিচার পাইনি।’
মৃত্যুর আগে গৃহবধূ আরও জানান, ‘পাওনা টাকার জন্য প্রথমে জয়নাল তাকে নিয়মিত ধর্ষণ করতে থাকে। পরে তার সহযোগী আলম, শুক্কুর ও সোলেমানকে নিয়ে এসে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। মোবাইল ফোনে সে ভিডিও ধারণ করে, তা প্রকাশের হুমকি দিয়ে ধর্ষণের ঘটনা কাউকে জানাতে ভয় দেখায়। এরপর নানাভাবে হুমকি দিয়ে জয়নাল ও শুক্কুর বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ করেছে। তাদের পাশবিক নির্যাতনে বাধ্য হয়ে বিষপান করেন তিনি।’
ভুক্তভোগী গৃহবধূ বলেন, ‘এরপরও জয়নাল আবার ফোন দিয়ে আমার কাছে টাহার (টাকা) চাপ দেয়। আমি বলি কীসের টাহা। টাহার জন্য এতো কিছু। সংসারে অশান্তি। টাহা ফেরত দিলে আমার ইজ্জত ফেরত দিবা। দিনের পর দিন আমারে শেষ করছো। তখন জয়নাল হুমকি দিয়া কয়, টেহা কীভাবে তোলা লাগে দেখমু।’
ওই গৃবধূর স্বামী বলেন, ‘আমি টাঙ্গাইল থাইকা ফিইরা দেখি বউয়ের শরীর ভাইঙ্গা গেছে। আমি জিগাইলে হে খালি কান্দে। পরে সব জানতে পারি। বিচার চাইলে তারা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। জয়নাল আমারে মাইরা ফেলার হুমকি দেয়।’
কত টাকা ধার নিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘর করার জন্য আমি ২০ হাজার আর স্ত্রী ২০ হাজার নিয়েছিল। পরে ২০ হাজার পরিশোধ করেছি। বাকি টাকার জন্য এত কিছু ঘটে গেলো।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যসহ স্থানীয়দের কাছে বিচার দিলেও কোনও সমাধান মেলেনি। গত শুক্রবার গৃহবধূ ও তার স্বামী বিষপান করেন। গুরুতর অবস্থায় তাদের রাজীবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু টাকা না থাকায় এই দম্পতি বাড়িতে চলে আসেন। বুধবার বাড়িতেই গৃহবধূর মৃত্যু হয়। পরে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই দম্পতি বিষপানের পর স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে থানা পুলিশ ভুক্তভোগীদের ২০ হাজার টাকা দেওয়ার বিনিময়ে ঘটনা মীমাংসার করার সিদ্ধান্ত দেয়। জয়নাল ভুক্তভোগীদের চিকিৎসার জন্য ২০ হাজার টাকা দিলেও তা নিতে অস্বীকৃতি জানান ওই দম্পতি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জয়নাল মিয়ার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়।
ধর্ষণের ঘটনা পুলিশকে নিয়ে কীভাবে টাকা দিয়ে মীমাংসার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই ওয়ার্ড মেম্বার বলেন, ‘অভিযুক্তরাই মীমাংসার কথা বলেছিল। এখন জয়নাল ও শুক্কুর কই আছে আমার জানা নাই।’
কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা নির্যাতনে গৃহবধূর মৃত্যু হলেও এটিকে অপমৃত্যু বলছেন রাজীবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ওনার মামা অভিযোগ করেছেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গৃহবধূকে কয়েক মাস ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ ও পাঁচ দিন আগে বিষপানের ঘটনা এলাকায় আলোচিত হলেও তা পুলিশের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি বলে দাবি করেন ওসি। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন কোনও অভিযোগ পাইনি। গৃহবধূর মামা আমাদের বলেছেন, বিষপান করেছেন। বিষপানে মৃত্যু হওয়ায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।’
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available