মুরাদুল ইসলাম, রাজীবপুর প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় পাওনা টাকা আদায়ের নামে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী দম্পতি আইনি ব্যবস্থা নিতে থানায় গেলেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। থানার গেট থেকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন ওই গৃহবধূর স্বামী।
বিষপানের একদিন আগে বিচারের আশায় থানায় গেলেও অভিযুক্ত জয়নাল, শুক্কুর ও এক পুলিশ সদস্যের যোগসাজশে ঢুকতে পারেননি বলে দাবি করেছেন গৃহবধূর স্বামী। বিচার না পেয়ে পরের দিনই তারা বিষপান করেন। এতে ওই গৃহবধূ মারা যান।
এর আগে পাওনা টাকা আদায়ের নামে জয়নাল ও শুক্কুরসহ তাদের সহযোগীদের দ্বারা দুই মাস ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই গৃহবধূ। বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ ও অভিমানে ২৪ মে বিষপান করেন স্বামী-স্ত্রী।
চার দিন চিকিৎসাধীন থেকে বুধবার ২৯ মে গৃহবধূর মৃত্যু হয়। বিষপান করার আগের দিন ২৩ মে তারা রাজীবপুর থানার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। তবে গেটে থাকা রবিউল নামে এক পুলিশ সদস্য ‘কড়া বিচারের’ আশ্বাস দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেন।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দম্পতি খালাতো ভাইবোন। তাদের মামা (মায়ের চাচাতো ভাই) আমেশ অভিযুক্তদের সঙ্গে মিলে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধা দেন। স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করতে বলেন। এতে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার ও দুই পুলিশ সদস্য।
স্ত্রীকে হারিয়ে কাতর ও বিষক্রিয়ায় অসুস্থ স্বামী বলেন, ‘শুক্কুররে আমি বড় ভাই মানি। জয়নাল আর হে মিলায় কেন আমার স্ত্রীরে নির্যাতন (ধর্ষণ) করলো হেইটা জানতে বিষুদবার ২৪ মে (বৃহস্পতিবার) স্ত্রীরে নিয়া শুক্কুরের কাছে গেছিলাম। বিচার চাইছি। কিন্তু শুক্কুর আমগো কথায় কান দেয় নাই।
পরে তারে বলছি, দেহি কোনে গেইলে বিচার পাই। এরপর ওই দিনই থানার দিকে যাই। জয়নাল আর আমেশ মামা এটা জানতে পাইরা কনস্টেবল রবিউলরে আগে থাইকা জানায় রাখে। থানার গেটের কাছে গেলে পুলিশের পোশাকে থাকা রবিউল আমাদের ডাইকা পাশের ইসলামী ব্যাংকের নিচে নেয়। এরপর একটা চায়ের দোকানে বসাইয়া আমাদেরকে “কড়া বিচার কইরা দিবো” বইলা থানায় যাইতে নিষেধ করে। আমাদের বাড়ি পাঠায় দেয়।
সেদিন সন্ধ্যায় জয়নাল, শুক্কুর এবং কনস্টেবল রবিউল, থানার ড্রাইভার মাজহারুলসহ সবাই মিলে বাড়িতে সালিশ বসায়। কিন্তু উপযুক্ত বিচার পাই না। লজ্জায়, ক্ষোভে পরের দিন বিকালে গ্রামবাসীর সামনে দুজনেই বিষ খাই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়নাল ও শুক্কুরকে সহযোগিতা করেছেন ভুক্তভোগী দম্পতির মামা আমেশ ও স্থানীয় মেম্বার আনোয়ার। তারা থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ধর্ষণের ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি। তাদের সহযোগিতা করেছেন পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুল। অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে মামা আমেশই ভিলেনের ভূমিকা পালন করে গেছেন।
বিষপানে গৃহবধূর মৃত্যু হওয়ার পর এটিকে ‘আত্মহত্যা’ হিসেবে চালিয়ে দিতে অপমৃত্যুর মামলা নথিভুক্ত করেন ওসি। অথচ বিষপানের পর চার দিন ধরে ওই দম্পতি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ওই দম্পতি প্রকাশ্যে বিষপান করার পর তাদের রাজিবপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের পাকস্থলী পরিষ্কার করেন চিকিৎসক। থানা থেকে সেই হাসপাতালের দূরত্ব মাত্র দেড়শ’ গজ! আর ঘটনাস্থল থেকে থানার দূরত্ব মাত্র ৫০০ গজ। এই সামান্য দূরত্বে প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটলেও থানা পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। বিষপানের চার দিনেও কোনও আইনি পদক্ষেপ নেননি ওসি। এমনকি ওই গৃহবধূর মৃত্যুর পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে তড়িঘড়ি করে মরদেহ দাফনের চেষ্টা করেন অভিযুক্তরা। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে মরদেহ উদ্ধার করে দায়সারা অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড করেন ওসি।
এদিকে, বুধবার ২৯ মে গৃহবধূর মৃত্যুর পর তার পরিবারের লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অভিযুক্ত জয়নাল, তার সহযোগী এবং আনোয়ার মেম্বারের ভয়ে তারা আইনি পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছেন। মামলা থেকে বিরত রাখতে এবং পরিবারটিকে কোনঠাসা করে রাখতে মেম্বার আনোয়ার ভুক্তভোগীর স্বামী এবং তার ভাইয়ের কাছে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগীর স্বামী বলেন, ‘আমি কী করমু। মামারে (আমেশ) দায়িত্ব দিছি। হে কী করে দেহি।’ গৃহবধূর শাশুড়ি বলেন, ‘ভয়ে কিছু করতে পারতাছি না। জয়নালরা যদি কোনও ক্ষতি করে!
ওয়ার্ড মেম্বার আনোয়ার ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে ঠিক কী উদ্দেশ্যে তিনি এমনটা করেছেন তার সদুত্তর দেননি। আর আমেশ গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।
থানার উদ্দেশ্যে যাওয়া দম্পতির সঙ্গে দেখা হওয়া ও সালিশে থাকার কথা স্বীকার করেছেন অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ইসলাম। এ নিয়ে ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওদের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। সালিশেও ছিলাম। এখন একটু বাইরে আছি, এগুলো নিয়ে পরে সাক্ষাতে কথা বলবো।
রাজীবপুর থানার ওসি আশিকুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে পুলিশ কেস আসলে তা থানায় অবহিত করা হয়। কিন্তু ওই দম্পতির বিষপানের বিষয়টি থানায় জানানো হয়নি। আর নির্বাচন উপলক্ষ্যে থানায় পর্যাপ্ত ফোর্স ছিল না। ফলে থানার কাছে ঘটনাটি ঘটলেও তা পুলিশের নজরে আসেনি।
তবে পুলিশ কনস্টেবল রবিউল বিষয়টি জানতো বলে স্বীকার করেছেন ওসি। রবিউলের ভূমিকা প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘তিনি (রবিউল) বলেছেন তাকে সালিশে ডাকা হয়েছিল। তিনি গিয়ে চলে এসেছেন। এত কিছু তার জানা ছিল না।’ পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্তের আশ্বাস দেন ওসি।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available