রংপুর ব্যুারো: রংপুরের কাউনিয়ায় আল আমিন শিশু সদনের অনুমোদনহীন কমিটির স্বাক্ষরে ভুয়া বিল ভাউচারে এতিমদের বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে এবার উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সামিউল আলমের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ওই এতিমখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এতিমের টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
তবে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার জানান, টাকা উত্তোলন করে অফিসিয়াল একাউন্টে জমা রাখা হয়েছে। এখানো ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের হিসাবে হস্তান্তর করা হয়নি। তবে গত আট বছর ধরে তিনি উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার থাকা অবস্থায় এতিমখানার টাকা তুলে কী করা হয়েছে তার সদুত্তর দিতে নাজার তিনি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে আল আমিন শিশু সদন এতিমখানার ৫৮ জন এতিম শিশুর জন্য (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ম কিস্তির ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। নিয়ম রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়ে বেসরকারি এতিমখানা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কমিটির স্বাক্ষরিত নিবাসী এতিমদের তালিকা ও ব্যয়ের বিল ভাউচার দাখিল করবে। সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তা ওই এতিমখানার নিবাসী এতিম শিশুর সংখ্যা, কমিটির মেয়াদ যাচাই-বাছাই করে এতিম শিশুর খাওয়া, পোশাক ও চিকিৎসার ব্যয় বিল ভাউচার অনুমোদন দেবে। অথচ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আল আমিন শিশু সদনের কার্যকরী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। আর নতুন কার্যকরী কমিটির অনুমোদন দেয় জেলা সমাজসেবার উপ-পরিচালক।
জেলা সমাজসেবার কার্যালয় সূত্র জানায়, এখনো ওই এতিমখানার নতুন কার্যকরী কমিটির অনুমোদন হয়নি। অথচ, সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অনুমোদনহীন কার্যকরী কমিটি ও তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষরিত ব্যয় বিল-ভাউচার অনুমোদন করে এতিম শিশুর জন্য ষানমাসিক বরাদ্দ বাবদ ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিউল ইসলাম।
উপজেলা হিসাব রক্ষণ কার্যালয় সূত্র জানায়, ৪ জুন উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে ওই এতিমখানার নিবাসী এতিমদের বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের জন্য কার্যকরী কমিটির রেজুলেশন, কর্মকর্তার প্রত্যায়নপত্রসহ অনুমোদন করা ব্যয় বিল-ভাউচার দাখিল করা হয়। ৬ জুন যাচাই-বাছাই করে সরকারি কোষাগাড় থেকে সেই টাকা উপজেলা সমাজসেবার অফিসিলায় ব্যাংকের হিসাবে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বেসরকারি এতিমখানায় নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি এতিমখানায় অবস্থানরত এতিমের মোট সংখ্যার সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ডের জন্য বিবেচিত হবে। গ্র্যান্ডপ্রাপ্তির শর্ত মোতাবেক চলতি অর্থবছর আল আমিন শিশু সদন এতিমখানায় ৫৮ জন এতিম নিবাসীর জন্য মোট এতিম থাকতে হবে ১১৬ জন।
স্থানীয়রা জানান, এতিমখানাটিতে ৮ থেকে ১০ জন এতিম ও দুস্থ শিশু রয়েছে। অথচ, চলতি অর্থবছরে সেখানে অতিরিক্ত ভুয়া নিবাসী এতিম শিশু দেখিয়ে ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও অতিরিক্ত ভুয়া এতিম শিশু দেখিয়ে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। সমাজসেবা কর্মকর্তার পরোক্ষ সহযোগিতায় বছরের পর বছর ধরে অর্ধশত অতিরিক্ত ভুয়া এতিম শিশু দেখিয়ে সরকারি অর্থ উত্তোলন করে বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা লোপাট করেছে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদপ্তর রংপুরের উপ-পরিচালক বরাবরে এতিমখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এতিমদের টাকা লোপাটের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন আব্দুস গফুর নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। এছাড়াও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে একই লিখিত অভিযোগের কপি দিয়েছেন তিনি।
তবে এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা ছমির উদ্দিন অভিযেগের বিষয় অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, গতবছর এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু ছিল। ওই বছর আগস্টে সমাজসেবা কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত প্রত্যায়নপত্র আছে। নীতিমালা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড প্রাপ্ত ৫৮ জন এতিম শিশুর তালিকা ও ব্যয় বিল-ভাউচার উপজেলা কার্যালয়ে দাখিল করেছেন। অতিরিক্ত এতিম দেখিয়ে অর্থের অনিয়ম যদি হয়ে থাকে তার দায়ভার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার। কারণ, ওই কর্মকর্তা প্রতিবছর পরিদর্শন করে এতিমখানায় নিবাসী শিশুর সংখ্যার প্রত্যায়নপত্র দিয়েছেন। যার ভিত্তিতে এতিম শিশুর জন্য বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
মাওলানা ছমির উদ্দিন আরও বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে কমিটির মেয়াদ শেষ হলে, নতুন কমিটি জমা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটির কাগজ বাতিল করে উপজেলা কর্মকর্তা তাঁর ব্যক্তিগত লোককে সভাপতি করে কমিটি গঠন করে। কমিটি এখনো অনুমোদন হয় নাই। আগের জমা করা কাজগপত্র বাতিল করে আবারও ব্যয় বিল-ভাউচার তৈরি করা হয়। সেই বিল-ভাউচারে অনুমোদনহীন কমিটি স্বাক্ষর করে এবং উপজেলা কর্মকর্তা অনুমোদন দিয়ে টাকাও উত্তোলন করেছে।
এদিকে এতিমখানার সাবেক সভাপতি শাহেনুর আলম বলেন, অর্থের অভাবে গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে এতিমখানাটি বন্ধ রয়েছে। শুনেছি, অতিরিক্ত এতিম শিশু দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে অভিযোগ হয়েছে। যদি এতিমের বরাদ্দের অর্থ লোপাট হয়ে থাকে এর দায়ভায় এতিমখানার তত্ত্বাবধায়কের এবং উপজেলা কর্মকর্তার। কমিটি এর দায়ভার নেবে না। কারণ, গতবছর এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার প্রত্যায়নপত্র উপজেলা কর্মকর্তা দিয়েছেন। তিনি যদি প্রত্যায়নপত্র না দিতেন তাহলে অতিরিক্ত এতিম শিশু দেখানোর সুযোগ থাকতো না তত্ত্বাবধায়কের।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সামিউল ইসলাম বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে অল্প সংখ্যক হলেও এতিম ও দুস্থ শিশু খাওয়া-দাওয়া করে। বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা না হলে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিভিন্নজনের সুপারিশে ১ম কিস্তির বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা হয়নি। অনুমোদনহীন কমিটির স্বাক্ষরে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন ও এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার প্রত্যায়নপত্র দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তর রংপুরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, আল আমিন শিশু সনদ এতিমখানার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভুয়া এতিম সাজিয়ে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তদন্ত কমিটির করা হয়েছিল। কমিটি গত ১৭ মার্চ তদন্ত করেছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানে চলতি অর্থবছর বরাদ্দের টাকা ছাড় না করার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা অফিসারকে বলা হয়েছে। শুনেছি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এখানো প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয় নাই। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার প্রত্যায়নপত্র কীভাবে দিয়েছে সেটা সংশ্লিষ্ট অফিসার বলতে পারবে। সার্বিক বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
এতিমের বরাদ্দ লোপাটের বিষয়টি রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসানের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ওই এতিমখানায় কোনো এতিম শিশু নেই বলে তিনি জানতে পেরেছেন। ইতিপূর্বে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে টিআর/জিআর এর জন্য আবেদন করলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে খোঁজ নিতে বলা হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার খোঁজ নিয়ে কোনো এতিম শিশু না পাওয়ার প্রতিবেদন দিলে টিআর/জিআর বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এতিমের বরাদ্দ লোপাটসহ সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available