রাজশাহী প্রতিনিধি: রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুরে অনুমোদনহীন ‘নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারের’ বিরুদ্ধে ভূয়া চিকিৎসা সনদ ও প্যাথলজিতে রোগীর রোগ নির্ণয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে নেই কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং টেকনিশিয়ান ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। রোগ পরীক্ষার চিকিৎসা যন্ত্র রয়েছে কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোকবল নেই। তবুও প্যাথলজিতে রোগীর রোগ নির্ণয় করা হচ্ছে। তবে প্যথলোজিতে দায়িত্বরত কর্মচারীরা বিশেষজ্ঞ সেজে নিজেরাই রোগ পরীক্ষার প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করছেন।
এই সকল জালিয়াতি করে চলছে স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টার। ওই সকল কর্মকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে কর্মরত (ব্রাদার) মিজানুর রহমান মিজানের বিরুদ্ধে। তিনি এই ডায়গনস্টিক সেন্টারটির মালিক বলে পরিচিত। তার জালিয়াতির খপ্পরে পড়ে রোগীরা যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন, তেমনি ভুয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের নামে প্রতারণার মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। শুধু তাই নয়, এই মিজান রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দালাল সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৮ জুন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেতরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সন্ধ্যায় নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারের তিন নারী দালালকে আটক করে হাসপাতালের কর্মরত আনসার সদস্যরা। এসময় তাদের ছাড়াতে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ছুটে যান ব্রাদার মিজানুর রহমান। পরে তিনি হাসপাতালে মুচলেকা দিয়ে ওই তিন নারী দালাল সদস্যকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এতে হাসপাতালের অনান্য ব্রাদারের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের বেশ কয়েকজন ব্রাদার জানান, মিজান দীর্ঘ দিন ধরে এই হাসপাতালে রয়েছে। তিনি সরকারি চাকুরি করলেও সে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছে। যদিও সেটি সরকারি চাকরি আইন পরিপন্থী। দীর্ঘ সময় চাকরির সুবাদে হাসপাতালের দালালদের সাথে মিজানের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ১৩, ১৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদিনই মিজান এই দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর সে নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়োগনস্টিক কনসাল্টেশন সেন্টারে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর জন্য তার প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে থাকেন। মিজানের এমন ঘটনার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেন। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রতিনিয়তই দালাল সিন্ডিকেট নেটওয়ার্ক শক্ত করে গড়ে তুলেছেন এই মিজান।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২৮ জুন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়েশা বেগম নামে ১৫নং ওয়ার্ডে এক বয়স্ক নারী রোগীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই রোগীকে চিকিৎসক ইলেকট্রলাইট ও সিভিসি পরীক্ষা করতে দেন। এরপর সেই নমুনাটি নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারে পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। মাত্র ১ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই রোগীর দুটি পরীক্ষার সনদ দেয় নিউ রাজশাহী নিউ স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
আর সেই সনদটি তৈরি করা হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের বায়োকেমিন্ট্রি বিভাগের (অব:) সহকারী অধ্যাপক ডা. ইরফান রেজার নামে। অথচ (অব:) এই অধ্যাপক তিনি নিজেও জানেন না তার স্বাক্ষর জাল করে তৈরি করা হয়েছে ভুয়া সনদ।
ডা. ইরফান রেজা বলেন, গত ২৮ তারিখ রাতে আমি ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যায়নি। সনদে ব্যবহারকৃত স্বাক্ষরটি তার নয় বলেও দাবি করেন। তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
নিউ স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির চেয়ারম্যান তার বাবা জয়নাল হোসেন। মিজানের পিতা জয়নাল পেশায় একজন মুয়াজ্জিন। তিনি বগুড়া জেলার মাগুরা গ্রামে থাকেন। মুয়াজ্জিনের পাশাপাশি তিনি কৃষিকাজ করেন। তবে নিউ স্কয়ার ডায়গনস্টিক সেন্টারে চেয়ারম্যান হিসেবে জয়নাল হোসেনের নাম উল্লেখ থাকলেও তিনি এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কখনো যান না। ফলে মিজানই এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সব কিছু দেখভাল করেন।
এসব বিষয়ে নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেয়ারম্যান জয়নাল হোসেনের সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে চাইলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে রামকে হাসপাতালের ব্রাদার ও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিজানুর রহমান মিজান বলেন, এরই মধ্যে আমি ওই প্রতিষ্ঠানে ইস্তফা দিয়েছি। ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। সরকারি চাকরি করে কীভাবে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক হলেন প্রশ্নের জবাবে মিজান বলেন, বিষয়টি আমার ভুল হয়েছে, সেটি আমি বুঝতে পেরেছি। তাই ইস্তফা দিয়েছি। আর যাদের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শেয়ার নামে টাকা নেওয়া হয়েছে, সেই টাকা অল্প সময়ের মধ্যে ফেরত দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহাম্মদ জানান, এরই মধ্যে হাসপাতালের ব্রাদার মিজানের বেশ কিছু অভিযোগ সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি। অনুসন্ধান করে তার বিরুদ্ধে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউ স্কয়ার রাজশাহী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোনো অনুমোদন নেই। তবে তারা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। যদি সত্যি তারা এমন অনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক আনোয়ারুল কবির।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available