কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি: ‘মাত্র আড়াই মাস আগে ওর বাবা মরে গেছে। আমার বেটার টাকায় চলত বড় ছোয়ালের পড়াশোনাসহ চারজনের সংসার। বেটা আর নাইরে। এহন কিডা চালাবিনি সংসার।'
২৮ জুলাই রোববার বিলাপ করতে করতে ভাঙা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী বুলজান খাতুন। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের মৃত সাবের আলীর স্ত্রী।
তার ছোট ছেলে আব্দুস সালাম (২৪) নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় একটি দশতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় সাজসজ্জার কাজ করছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই শনিবার বিকেলে ওই ভবনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
ঘটনার চারদিন পর ২৩ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়িতে আনা হয় তার মরদেহ। রাতে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আছেন স্ত্রী মারিয়া খাতুন (২০), দেড় বছর বয়সি সন্তান মাহিম, বড় ভাই আলামিন (২৫) ও মা বুলজান খাতুন। আলামিন রাজবাড়ী জেলার পাংশা সরকারি কলেজের অনার্স (বাংলা) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বজনরা।
বুলুজান খাতুনের দাবি, ‘তার ছেলে হত্যার সঠিক বিচার করতে হবে। পাশাপাশি যোগ্যতা অনুযায়ী বড় ছেলের চাকুরিসহ ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডে আধাপাকা ঘরের মেঝেতে সালামের মাকে ঘিরে বসে আছেন স্বজন ও উৎসুক জনতা। তার মা বিলাপ করছেন। আরেকটি কক্ষে শুয়ে আছেন শোকে মাতম স্ত্রী মারিয়া খাতুন। তিনি অসুস্থ। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। পাশেই বিছানার ওপর খেলা করছে দেড় বছর বয়সী একমাত্র সন্তান মাহিম। সে জানে না যে, তার বাবা আর নেই।
এ সময় সালামের শ্বাশুড়ি শিল্পী খাতুন জানান, জামাইয়ের শোকে অসুস্থ মেয়ে। নাতি জানে না যে, তার বাবা আর নেই। এখন কে দেখবে ওদের। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
কান্না জড়িত কণ্ঠে ভাই আলামিন বলেন, 'শনিবার বিকেলে হঠাৎ ফোন দিয়ে সালাম আমাকে বলল, ভবনে আগুন দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি (সালাম) মনে হয় আর বাঁচবনানে। তুই আমার স্ত্রী, সন্তান ও মাকে দেখে রাখিস। এরপর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও আর ওর সন্ধান পাইনি। পরে গত রোববার জানা যায় ভাই আর নেই।’
তিনি আরও বলেন, ভাইয়ের টাকায় চলতো আমার পড়াশোনাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ। এখন কীভাবে কী করব তা বুঝতে পারছি না। আমি ঘাতকদের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানাই।’
জানা গেছে, সেদিন ডাচ্ বাংলা ব্যাংকে ইন্টোরিয়র ডিজাইনের কাজ করছিলেন একই গ্রামের ওহাব মন্ডলের ছেলে সেলিম মন্ডল (২৮), তার ভাতিজা ওয়াজেদ আলীর ছেলে মো. ফয়সাল মন্ডল (১৮), মো. কাদেরের ছেলে মো. পারভেজ, আবুল মাস্টারের ছেলে আব্দুল হামিদ ও আক্কাস বিশ্বাসের ছেলে মাহবুব বিশ্বাস। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে সেদিন তাদের মধ্যে নিহত হয়েছেন সেলিম মন্ডল। তার মরদেহও ২৩ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আনা হয়েছে গ্রামে। রাতে একই কবরস্থানে মরদেহটি দাফন করা হয়। আর অন্যরা আহত হয়েছেন আগুনে পুড়ে। আহতদের মধ্যে হামিদ ঢাকায় একটি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আর ফয়সাল, পারভেজ ও মাহবুব বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আহত ফয়সাল মন্ডল বলেন, তারা ১৪ জন ব্যাংকের সাজসজ্জার কাজ করছিলেন। সেদিন দুপুরেই ভবনের বাইরে থেকে শুধু গুলির আওয়াজ আসছিল। পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র মারা গিয়েছিল। আর বিকেলে ব্যাংকের গেটে আগুন দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। আগুনের কারণে প্রচুর ধোঁয়া ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমার কাকুরা (সেলিম ও সালাম) তিনতলায় চলে গিছিল। আর অনেকক্ষণ প্রাণপন চেষ্টা করে আমরা কয়েকজন নিচে চলে আসছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আগুনে আমার দুই পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে।
নিহত সেলিম মন্ডলের স্ত্রী শোভা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, শনিবার বিকেলে ফোনে শেষ কথা হয়েছিল। ফোনে বারবার বলছিল প্রচুর ধোঁয়া। নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। হয়তো আর বাঁচবা না। বাবা, মা, মেয়েকে দেখে রেখো।
তিনি আরও বলেন, এখন আমাদের দেখবে কে? তিন বছরের মেয়ে হুমাইরাকে নিয়ে কোথায় যাব? তিনি স্বামী হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত কুমারখালী বাড়ি এমন একজন ছাত্রসহ ৪ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পরিবার থেকে লিখিত আবেদন করলে সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ আসলে তা প্রদান করা হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available