স্টাফ রিপোর্টার, পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় পানি-স্যানিটেশন প্রকল্পে অনিয়ম ফলে চরম দূর্ভোগে শতাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী।
উপজেলার ঝলই শালশিরি ইউনিয়নের ভীমদামাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুপেয় পানি ও স্বাস্থসম্মত টয়লেট নির্মাণের জন্য পিইডিপি প্রকল্পের অধিনে ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে। ওয়াশব্লকের গ্রেড বিমের কাজ করে উধাও হয়ে যায় নন্দন প্রেস নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে নির্মাণ কাজ। গ্রেড বিমের উপরে উচিয়ে রাখা লোহার রডেও ধরেছে মরিচা। নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে রডের গুনগত মান।
অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ নন্দন প্রেস পেলেও সাব ঠিকাদারের মত কাজ দেখাশোনা করছেন তৎকালীন বোদা উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী ও বর্তমানে জেলা জনস্বাস্থ্য অফিসে একই পদে কর্মরত নুনী গোপাল সিংহ। মাত্র ১০ শতাংশ কাজ করেই ৬০ শতাংশ বিল ওই কর্মকর্তার যোগসাজসে তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া বোদা পৌরসভার বানিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লকের কাজ শুরু হয় একই বছরের মার্চে। ছাদ ঢালাই করার পর কাজ বন্ধ হয়ে আছে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে। দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ হওয়ার পর আর আলোর মুখ দেখেনি। সেপটিক ট্যাংকটিও খোলা রাখা হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ের শিশুরা খেলাধুলা করছে। কাজ শেষের সময়সীমার ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও কাজ করার তেমন কোন তৎপরতা নেই ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এতে পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। প্রকৌশলী নুনী গোপালের সহযোগিতায মাত্র ২০ শতাংশ কাজ করে ৬০ শতাংশ বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। দ্রুতই কাজ শেষ করার তাগিদ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
একই অবস্থা বোদা উপজেলার মন্নাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ওয়াশব্লকের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের মার্চে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ভেঙ্গে পড়েছে ওয়াশব্লকের গ্রীল ও দেয়াল। বিদ্যালয় ভবনের সামনে বালি ফেলে রাখায় অসুবিধায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দেড় বছর ধরে থেমে আছে কাজ। বারবার যোগাযোগ করা হলেও কোন তাগাদা নেই কর্তৃপক্ষের। ৫০ শতাংশ কাজ করে ৭০ শতাংশের বেশি বিল তুলে নিয়েছে নন্দন প্রেস।
একই অবস্থা উপজেলার জোতমনিরাম ও নবাবগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৩০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। সব গুলো কাজই করছে নন্দন প্রেস নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কাজ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ওয়াশব্লকের নির্মাণ কাজ। কোনটির ২০ শতাংশ আবার কোনটির কাজ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত করেই অর্ধেকেরও বেশি বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঠাকুরগাঁয়ের নন্দন প্রেস। তিন প্যাকেজে ৩০ কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে তুলে নিয়েছেন ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এছাড়াও ছুটির দিনে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক বলেন, পঞ্চগড় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নুনী গোপাল সিংহ নন্দন প্রেসের নামে কাজ নিয়ে নিজেই তার লোকজন দিয়ে কাজ করছেন বলে তিনি জেনেছেন। অন্য ঠিকাদারদের কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হলেও নন্দন প্রেসের কাজ পরে রয়েছে। এতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে।
মন্নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুভশ্রী রায় বলেন, আমাদের পুরনো টয়লেটটি অস্বাস্থ্যকর। তারপরও আমরা খুব কষ্ট করে ব্যবহার করছি। নতুন টয়লেটের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। অনেক সময় আমাদের বাথরুমের চাপ চেপে রাখতে হয়। এটি তাড়াতাড়ি চালু করলে আমাদের জন্য খুব উপকার হয়।
বানিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজন কুমার সরকার বলেন, দেড় বছর ধরে আমাদের ওয়াশব্লকের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। বার বার তাগাদা দেয়া সত্যেও তারা কাজ করছে না। সেপটিক ট্যাংকটিও খোলা রেখে চলে গেছে। আমরা খুব কষ্টে পুরনো টয়লেটটি ব্যবহার করছি।
মন্নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেফালী বেগম বলেন, তারা কাজ বন্ধ রেখে চলে গেছে দীর্ঘদিন হলো। পরে তাদের আর সাড়া পাচ্ছি না। তারা নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করেছে। দেয়াল ভেঙে গেছিল। তারা ছুটির দিনে কাজ করে। ঠিকাদার ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কেউ আসে না। মিস্ত্রীরাই কাজ করে চলে যায়। আমি ঠিকাদারকে কল করলে তিনি আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদেরও কোন সাড়া নেই। আমরা খুব কষ্ট করে পুরনো টয়লেট ব্যবহার করছি। বিদ্যালয় ভবনের সামনে বালু ফেলে রেখেছে। শিশুরা ঠিকভাবে খেলতেও পারছে না।
নবাবগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের একটি টয়লেট এক ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে। এক ঘন্টা ব্যবহার করলেই টয়লেট আর ব্যবহারের উপযোগী থাকেনা। খুব কষ্টে আছি আমরা। বিশেষ করে আমাদের নারী শিক্ষক ও ছাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছে।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নন্দন প্রেসের মালিক শফিউল আলম বলেন, যেটুকু কাজ করেছি সেটুকুরই অনেক টাকা বিল বকেয়া রয়েছে। তাই কাজ বন্ধ আছে। জুন পর্যন্ত আমরা কাজ করতে পারবো। হয়তো মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কিছু চার্জ নিবে তারা। কাজে অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
তবে ঠিকাদারের কাজ করা ও বিল নিতে সহযোগিতা করার বিষয়টি অস্বীকার করে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী নুনী গোপাল সিংহ বলেন, আমরা বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। অভিযোগকারীসহ আপনারা প্রমাণ করেন। তাছাড়া ক’জন ঠিকাদার সাইডে (কাজ দেখতে) যান। ম্যানেজারেরাই তো দেখাশোনা করেন। আমাদেরও কাজ দেখতে যেতে হয়। তাদের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।
পঞ্চগড় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মিনহাজুর রহমান বলেন, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যেই যেসব ওয়াশব্লকের কাজ বাকি রয়েছে, তা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। কাজে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। ঠিকাদারদের কাজের উপর ভিত্তি করেই তাদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। জেলায় মোট ৪৮৭ টি ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ হচ্ছে। কাজ শেষ হয়েছে ৩৭৬টির।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available