মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় পাইকারি সবজির আড়তে কৃষকদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি ও পরিবহনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম জুয়েলসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে। পতিত স্বৈরাচার সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মালিকানাধীন সবজির পাইকারি আড়ত ছাড়া অন্য কোথাও কৃষকেরা সবজি বিক্রি করতে চাইলেই বাধার সম্মুখীনসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা।
এ বিষয়ে কৃষক ও গোলড়া-কামতা বহুমুখী কাঁচামালের আড়তের পক্ষ থেকে মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। নিরাপদে পাইকারি বাজারে কৃষকরা যাতে স্বাধীনভাবে তাঁদের উৎপাদিত সবজি ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে এমন পরিবেশ তৈরি জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করেন কৃষক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
১৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ভোর তিনটার দিকে সাটুরিয়া উপজেলার জান্না এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালিকানাধীন পাইকারি সবজির বাজারে মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শীতকালীন সবজি বিক্রির জন্য নিয়ে আসছে। আবার অনেক কৃষককে দেখা গেছে, ভ্যান ভর্তি বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রির জন্য গোলড়া-কামতা বহুমুখী কাঁচামালের আড়তে নিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গোলড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যেসব কৃষকরা ভ্যানে করে শীত কালীন বিভিন্ন সবজি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আড়তে না নিয়ে অন্য আড়তে নিয়ে যেতে চাইলে তাঁদের সবজি ভর্তি ভ্যানগুলোর গতিরোধ করছে ধানকোড়া ইউপি বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম জুয়েলের ভাতিজা উপজেলা সেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সবুজ হোসেন ও তার অনুসারীরা। এসময় কৃষকদের অন্য কোনো আড়তে সবজি বিক্রি না করতে বললে তাদের পরিবহণ ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরে কৃষকরা বাধ্য হয়েই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালিকানাধীন আড়তে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে এ দুটি আড়ত থেকেই প্রতিদিন টাটকা বিভিন্ন ধরনে সবজি রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সাভার, আশুলিয়া, ধামরাইসহ বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ হয়ে থাকে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালীকানাধীন সবজির আড়তে কৃষকরা সবজির ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং যাতায়াতে সুবিধার্থে গোলড়া এলাকায় নতুন আড়ত করা হয়েছে। এতে ওই আড়তের কৃষকের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকায় ধানকোড়া ইউপি বিএনপির সভাপতি তার অনুসারী দিয়ে কৃষকদের নানাভাবে হয়রানি করাসহ সবজি বিক্রিতে পথে পথে বাধা দিচ্ছে। কৃষকদের বাধ্য করা হচ্ছে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আড়তে সবজি বিক্রির জন্য। এতে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সাথে স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এতে প্রান্তিক কৃষক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে এবং কৃষিপণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
সাটুরিয়ার ফুকুরহাটি ইউনিয়নের আইড়মারা গ্রামের কৃষক মো. আরশেদ আলী এশিয়ান টিভিকে বলেন, আমাদের পরিচিত পাইকার ব্যবসায়ী আছে। তার কাছেই সারা বছর সবজি বিক্রি করি। গোলড়া এলাকায় নতুন আড়তে সবিজ মালামাল নিয়ে আসার পথে স্থানীয় রাজ্জাকসহ তার কয়েকজন ভাই মিলে আমাদের সবজি ভর্তি অটোবাইকটির গতিরোধ করে। পরে আমাদের গালাগালও করেছে, বলে এত দিন এই বাজারে মাল বিক্রি করছো, এখন আবার ওই আড়তে মাল নিতাছো কেন। মাল নিয়া ফিরা যাও।
তিনি আরও বলেন, তাদের অনেক অনুরোধ করে বলেছি নতুন আড়তে আমাদের পরিচিতি ব্যাপারীরা আমাকে ফোন করে মাল নিয়ে যেতে বলেছে। তারপরও আমাদের আসতেই দিলো না, প্রায় দেড় ঘণ্টা সেখানে আটকে রাখছে। আমরা কৃষকরাও মানুষ, যে কোনো আড়তে আমাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করার অধিকার আছে। প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করে তিনি বলেন, আমরা যাতে নিরাপদে জেলার সবগুলো পাইকারি আড়তেই কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারি। কেউ যাতে আমাদের সবজি বিক্রিতে বাধা দিতে না পারে, এটাই আমাদের দাবি।
সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউপির বাঙ্গালা গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, আমরা কৃষক মানুষ, কৃষি কাজ করে খাই। পতিত সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আড়তের সামনে দিয়ে কৃষিমাল নিয়ে গোলড়া নতুন আড়তে আসতে গেলেই আমাদের বাধা দেয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর লোকজন আমাদের নানাভাবে হয়রানি করে। পরে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড ঘুরে এই গোলড়া নতুন আড়তে মাল নিয়া আসতে হয়। মন্ত্রীর আড়তে সবজি দাম কম পাই, আর নতুন আড়তের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সবজির দামটা ভালো পাই। যে আড়তে দাম ভালো পাব, আমরা সেখানেই কৃষিমাল বিক্রি করবো। এটা আমাদের অধিকার। ওই আড়ত থেকে নতুন আড়তে প্রতি মণে ১৫০ টাকা বেশিতে কৃষি পণ্য বিক্রি করতে পারি।
গোলড়া এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী আবদুল জলিল দুটি আড়তের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরে বলেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাজারটি মহাসড়ক থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়ায় আমাদের যাতায়াতে সমস্যা হয়। অনেক সময় গাড়িও পাওয়া যায় না। বেশ কিছু রাস্তা ফাঁকা থাকায় ডাকাতি ঘটনাও ঘটে। কারণ আমাদের কাছে দুই-চার লাখ টাকা থাকে। গত ১৫ দিনে ওই আড়তে যাওয়ার রাস্তায় দুই বার ডাকাতি হয়েছে। আর এই নতুন আড়তটি মহাসড়কের কাছাকাছি হওয়ায় এই ঝুঁকি নাই। এখান থেকে কৃষিপণ্য কিনে সহজেই ঢাকায় পরিবহণ করা যায়। তারা (মন্ত্রীর আড়তের লোকজন) কৃষকদের মাল নিয়ে আড়তে আসতে দেয় নাই। লোকজন নিয়ে এসে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।
গোলড়া-কামতা বহুমুখী আড়তে উদ্যোক্তা শরিফুল হক রতন বলেন, আমরা চাষিদের কথা চিন্তা করে এই নতুন কাঁচামালের আড়ত দিয়েছি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গোলড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা সড়ক বিভাজন হওয়ার কারণে কৃষক ভাইদের অনেক কষ্ট হয় অন্য আড়তে কৃষিমাল পরিবহণ করতে। কৃষকরা নতুন আড়তে বিভিন্ন ধরনের সবজির ভালো দামও পাচ্ছেন এবং পরিবহণ সুবিধাও ভালো। মহাসড়কের পাশে হওয়াতে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে কৃষি পণ্য ক্রয় করতে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে ধানকোড়া ইউপি বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি বা আমার কোন লোকজন কৃষকদের সবজি বিক্রিতে বাধা দিচ্ছে না। আমরা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালিকানাধীন আড়তে চাঁদাবাজি বন্ধ করেছি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে আড়তটি সচল রাখার জন্য কাজ করছেন? এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগই নাই, কোনো কথাই হয় নাই। মন্ত্রী মহোদয়ের ওখানের কারো সাথে আমার কখনো কথাই হয় নাই। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
উলটো অভিযোগ করে তিনি বলেন, গোলড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একসময় সবজি আড়ত আমাদের ছিল। পরে সেটি মন্ত্রীর (জাহিদ মালেক) লোকজন জোড় করে জান্না এলাকায় নিয়ে যায়। ৫ আগস্ট পতিত সরকারের পতনের পর আবারও মহাসড়কের পাশে আড়ত বসানো চেষ্টা করা হয়। পরে আমি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন লিখিতভাবে অবগত করেছি। তারা বিএনপির অন্য পক্ষ মানে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি আতাউর রহমান আতা ভাইয়ের লোকজন। তারাই এই নতুন আড়ত দিয়েছে এবং তারাই কৃষকদের জোড় করে টানাটানি করে নতুন আড়তে যাওয়ার জন্য বলছে।
এ বিষয়ে সাটুরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, অভিযোগ পেয়েছি এবং আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তবে আড়ত দুটি পাশাপাশি। কৃষকেরা যে কোনো আড়তে তাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করবে, এটা তাদের ইচ্ছা। এখানে কেউ তাদের সবজি বিক্রিতে বাধা দেওয়া বা হয়রানি করার কোনো সুযোগ নেই।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available