আরমান মিয়া, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ): কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভুল ইনজেকশন দেওয়ায় দুই রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ১৫ জানুয়ারি বুধবার সকালে হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে দুই রোগীর মৃত্যু হাসপাতালজুড়ে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করে। বিক্ষুব্ধ স্বজন ও শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
নিহতরা হলেন- কটিয়াদী উপজেলার পূর্ব সহস্রাম গ্রামের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা মল্লিক মিয়া (৩২) এবং নিকলীর নোয়াপাড়া গ্রামের ইটভাটা শ্রমিক জহিরুল ইসলাম (২৮)।
মল্লিক মিয়া হার্নিয়ার অস্ত্রোপচারের জন্য ৭ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। তার সাড়ে তিন বছরের একটি ছেলে রয়েছে। অন্যদিকে, জহিরুল ইসলাম পরিপাকতন্ত্রের ছিদ্রজনিত সমস্যার কারণে ১২ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। তার ছয় বছরের একটি ছেলে ও চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। তার স্ত্রী আকলিমা আক্তার বর্তমানে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, বুধবার সকালে সহযোগী অধ্যাপক ডা. খাজা মাসুদের অধীনে দুই রোগীর অস্ত্রোপচার করার কথা ছিল। অস্ত্রোপচারের আগে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওয়ার্ডে তাদের একটি অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিনিয়র স্টাফ নার্স নাদিরা আক্তার ভুলবশত অ্যান্টিবায়োটিকের পরিবর্তে অ্যানেসথেশিয়া ইনজেকশন দিয়ে দেন।
ইনজেকশন নেওয়ার পরপরই দুই রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ সময় অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে থাকা সার্জন ডা. খাজা মাসুদ ওয়ার্ডে উপস্থিত ছিলেন না। সাধারণত রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত করার পরই তিনি অপারেশন থিয়েটারে যান।
এ ঘটনার পরপরই হাসপাতালে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নিহত শিক্ষক মল্লিক মিয়ার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন। তারা হাসপাতালের সামনের প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভের খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে স্বজনরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের দায়ী করে বিচার দাবি করেন।
নিহত মল্লিক মিয়ার স্ত্রী বলেন, সকালেও আমার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি সুস্থ ছিলেন। ভুল ইনজেকশন দেওয়ার কারণে আমার স্বামী মারা গেছে। আমি এর বিচার চাই।
ইটভাটা শ্রমিক জহিরুল ইসলামের বড় ভাই মাসুক মিয়া বলেন, আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। শুধুমাত্র নার্স নয়, এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরাও দায়ী। আমরা সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।
এ ঘটনায় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নাসিরুজ্জামানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে সার্জারি, মেডিসিন ও অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের চিকিৎসকরা রয়েছেন।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হেলিশ চন্দ্র সরকার বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দোষী নার্স নাদিরা আক্তারকে ইতোমধ্যেই দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা প্রক্রিয়াধীন।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। নিহতদের পরিবারকে দাফনের জন্য ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত নার্স নাদিরা আক্তার পলাতক রয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তার বাড়ি বাজিতপুর উপজেলার উত্তর সরারচর এলাকায়।
তবে হাসপাতালের ভেতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরাও কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ইনজেকশন দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। ফলে শুধু নার্স নয়, চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কঠোর নজরদারি ও প্রশিক্ষণ জরুরি। ভুল চিকিৎসা যেন মানুষের জীবন কেড়ে না নেয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
কিশোরগঞ্জ মেডিকেলে ঘটে যাওয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি চিকিৎসা ব্যবস্থায় গাফিলতির আরেকটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিহতদের পরিবার ও সাধারণ মানুষের দাবি, তদন্তে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available