কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে ঐতিহ্যবাহী গোপিনাথপুর দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে জমে উঠেছে মেলা। শত শত বছর ধরে চলে আসা এই মেলা শুধু দোল উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু নয়, এটি উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম পশুর হাট হিসেবেও পরিচিত। বিশেষ করে, ঘোড়ার মেলা হিসেবে এটি সুপরিচিত, যেখানে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের মিলন ঘটে।
এবারের মেলায় এসেছে দেশের নানা প্রান্তের বাহারি ঘোড়া; বিজলি, কিরণমালা, রানী, সুইটি, ভারতীয় তাজীসহ অনেক নামী ঘোড়া। ক্ষিপ্রতা, শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার কারণে এসব ঘোড়ার কদর অনেক বেশি। ক্রেতারা তাদের পছন্দের ঘোড়া কিনতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
মেলা আয়োজকদের তথ্য অনুযায়ী, ৫১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে গোপিনাথপুরে দোল পূর্ণিমার সময় এই মেলা বসে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রায় সোয়া পাঁচশ বছর আগে এক সাধক নন্দিনী প্রিয়া গোপিনাথপুর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে গভীর জঙ্গলে একটি মন্দির স্থাপন করেন। সেখানে পূজা-অর্চনার আয়োজনের মধ্য দিয়েই মূলত এই মেলার সূচনা হয়।
সে সময় বাংলার শাসক নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ গোপিনাথপুর ভ্রমণে এসে এই সাধকের আতিথ্য গ্রহণ করেন। মুগ্ধ হয়ে তিনি তাম্রফলকে লিখে গোপিনাথপুর ও গোপালপুর মৌজার সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে দান করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার সময় এখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এই মেলাকে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র ঘোড়াবেচাকেনার হাট হিসেবে ধরা হয়। সারা দেশ থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা আসেন এখানে। যদিও মেলা মাসব্যাপী চলে, তবে প্রথম ১০ দিন মূলত পশুর হাট বসে। এবারের মেলাতেও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঘোড়া ব্যবসায়ীরা এসেছেন, তাদের মধ্যে আছেন জামালপুরের রফিকুল ইসলাম, যিনি গত ৪৫ বছর ধরে এই মেলায় আসেন এবং এবার নিয়ে এসেছেন ৪৭টি ঘোড়া।
এবারের মেলায় সবচেয়ে দামি ঘোড়ার মধ্যে রয়েছে একটি ভারতীয় তাজী ঘোড়া, যার দাম হাঁকা হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইউনুস আলীর পাঁচ বছরের ভুটিয়া ঘোড়া সবচেয়ে বেশি আলোচিত, যার দাম হাঁকা হয়েছে আড়াই লাখ টাকা।
ক্রেতারা ঘোড়া কেনার আগে মাঠে তাদের দৌড় পরীক্ষা করেন। দরদাম চূড়ান্ত হলে নির্ধারিত খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ার গতি, শক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করা হয়। তাই দর্শকদের জন্যও এটি এক বড় আকর্ষণ।
মেলায় শুধু ঘোড়াই নয়, গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া কেনাবেচাও হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় ঘোড়ার হাটেই। আশেপাশের গ্রামগুলোতে এ উপলক্ষে এক ধরনের উৎসবের আবহ তৈরি হয়।
মেলা আয়োজকদের মতে, এতো বড় মেলা হলেও বিস্তীর্ণ মাঠের অভাব রয়েছে, যা ঘোড়ার দৌড় ও ক্রেতা-বিক্রেতার লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা তৈরি করছে। তবে মেলার আয়োজক ও গোপিনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, রমজান মাসের কারণে এবার সার্কাস ও যাত্রাপালা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে গ্রামীণ মেলার অন্যান্য আয়োজন ঠিকই রাখা হয়েছে।
মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, পুলিশ ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী গোপিনাথপুর দোলযাত্রার মেলা শুধু একটি পশুর হাট নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উৎসব। দেশ-বিদেশ থেকে আগত ঘোড়া ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের মিলনমেলা এই মেলাকে আরও রঙিন করে তোলে। ঘোড়ার গতি, শক্তি ও শৈল্পিক সৌন্দর্য দেখতে যেমন মানুষের ভিড় জমে, তেমনি ব্যবসায়িক দিক থেকেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
সময় বদলালেও ৫১৭ বছরের ঐতিহ্য বহন করা এই মেলা আজও তার গৌরব ধরে রেখেছে এবং উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য এটি এক অনন্য সাংস্কৃতিক আয়োজন।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available