নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি: পুরোই যেন ‘থ’ বনে গেছে নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ ভূমি পল্লি এলাকা থেকে আটক হয়েছেন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা প্রধান আতাউল্লাহ। কিভাবে মিয়ানমার থেকে নারায়ণগঞ্জ আসলেন আরসা প্রধান আতাউল্লাহ? নারায়ণগঞ্জে কতদিন ধরে বসবাস করছেন আরসা প্রধান এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন। আরসা প্রধান আতাউল্লাহ বসবাস করছিলেন নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু তার এ অবস্থান বিষয়ের সম্পূর্ণই অজ্ঞাত ছিল নারায়ণগঞ্জ প্রশাসন। কিভাবে আরসা প্রধান নিজের নাম পরিচয় সবকিছু গোপন রেখে নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছিলেন এ নিয়ে শুরু হয়েছে গভীর তদন্ত। নারায়ণগঞ্জে থেকে আতাউল্লাহ কি পরিকল্পনা করছিলেন, কি ছিল তারা নেক্সট মিশন এসব তথ্য উদঘাটনে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, র্যাব-১১ এর পৃথক দুটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ১৬ মার্চ ও ১৭ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার সদর থানা এলাকার নতুন বাজার গার্ডেন সিটি এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভুমি পল্লিতে পৃথক দুটি অভিযান পরিচালনা করে। এসময় নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে তিন নারীসহ ১০ সদস্যকে আটক করে। গ্রেফতারদের মধ্যে আটক হন আরাকান এআরএসএ আরকান বাহিনী প্রধান শীর্ষ নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী ওরফে আতাউল্লাহ। এছাড়া তার সহযোগী , মোস্তাক আহাম্মদ, মনিরুজ্জামান, সলিমুল্লাহ, মোসা. আসমাউল হোসনা, মো. হাসান, মো. আসমত উল্লাহ, মো. হাসান , মোসা. শাহিনা ও মোসা. সেনোয়ারা।
পরে মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী ও অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে র্যাব বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পর আরসা প্রধান আতাউল্লাহসহ আটকদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১৮ মার্চ মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে প্রেরণ করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। কিন্তু আটকদের মধ্যে আতাউল্লাহর নাম নিয়ে শুরু হয় জল্পনা কল্পনা। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে আটককৃত আতাউল্লাহ যে আরসা প্রধান তা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম কর্মীদের শুরু হয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের কাছে দৌড়ঝাপ। এক পর্যায়ে মঙ্গলবার রাতে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা নিশ্চিত করেন। আটককৃতদের মধ্যে আতাউল্লাহ মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা প্রধান। এ নিয়ে পুরো জেলার আই-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে শুরু হয় তোলপাড় ও নানা প্রশ্ন। কিভাবে আরসা প্রধান নারায়ণগঞ্জে এলেন এবং কতদিন ধরে সে নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছেন। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে আরসা প্রধানের উপস্থিতি ও অবস্থান নিয়ে গভীর তদন্তে নেমেছে নারায়ণগঞ্জ প্রশাসন।
কে এই আরসা প্রধান আতাউল্লাহ
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ। পুরো নাম- আবু আম্মার জুনুনী। জন্ম ১৯৭৭ সালে, পাকিস্তানের করাচিতে। বাবা গোলাম শরীফ। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অষ্টম তিনি। ৬ বছর বয়সে চলে যান সৌদি আরবের রিয়াদে। ইসলামি শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা করেন মক্কা ও রিয়াদে। ২০১৩ সালে আরসার প্রধান হিসেবে যোগ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি মিয়ানমার জান্তা সরকারের সৃষ্টি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালায় আরসা। ফলাফল স্বরূপ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন অভিযান। এর জেরে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠির সমর্থকদের কাছে এ আতাউল্লাহ নিজেকে একজন ‘মুক্তিকামী সৈনিক’ হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ে নামেন।
সমালোচকরা মনে করেন, তার বেপরোয়া সিদ্ধান্তে বিদ্রোহের কারণে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবন বিপর্যস্ত। ফলে তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য ‘অভিশাপ’।
ধারণা করা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ চেকপোস্টে আতাউল্লাহ’র নির্দেশেই হামলা চালিয়েছিল আরসা। এরপর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
জানা গেছে, ৩০ বছর বয়সেই সে একটি বিদ্রোহী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। শুরুতে এই সংগঠনের অল্প কয়েকটি বন্দুক ছিল, বেশিরভাগ সময় লাঠি ও ছুরি হাতেই হামলা চালাত তারা। পরবর্তিতে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র আসতে থাকে তাদের হাতে। বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ আরসা প্রধান আতাউল্লাহকে তার বাহিনী নিয়ে ছবি প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
আরসা প্রধান আতাউলার পারিবারিক বিষয়ে জানা যায়, তার বাবা করাচিতে দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর পরিবারসহ সৌদি আরব পাড়ি দেন। সেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন তার বাবা। এরপর এক বিত্তশালী পরিবারের নজরে আসে আতাউল্লাহ। সেই পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয় তাকে।
পরে সৌদি আরব থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যায় আতাউল্লাহ। এরপর রাখাইন গিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়। গড়ে তোলে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন। সেখান থেকেই তীব্র লড়াই চালিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
অবশেষে নারায়ণগঞ্জে ৬ সহযোগীসহ র্যাবের জালে ধরা পড়েন এ আতাউল্লাহ। ১৮ মার্চ মঙ্গলবার তাদের নারায়ণগঞ্জ আদালতে নেয়া হয়। এ সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের রিমান্ড আবেদন করেন। তবে তিনি কীভাবে মিয়ানমার থেকে নারায়ণগঞ্জ আসলেন সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি।
মামলা সূত্রে আরও জানা যায়, গ্রেফতারদের কাছ থেকে নগদ ২১ লাখ ৩৯ হাজার ১০০ টাকা, একটি চাকু, ধারালো দাতযুক্ত একটি স্টিলের মোটা চেইন ও চারটি হাতঘড়ি উদ্ধার করা হয়।
এবিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি নারায়ণগঞ্জ পাবলিক প্রসিকিউটর (নারী ও শিশু দমন ট্রাইবুনাল) খোরশেদ মোল্লা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভুমিপল্লি থেকে এআরএসএ এর একটি গ্রুপকে গ্রেফতার করা হলে তাদের দেয়া তথ্য মতে ময়মনসিংহ হতে অন্যান্যদের গ্রেফতার করা হয়।
নারায়ণঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান জানান, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলায় নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ১ম আদালতের বিচারক মো. মঈনুদ্দিন কাদিরের আদালতে হাজির করা হয়। এসময় শুনানী শেষে গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে দুই মামলায় বিচারক দশ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available