রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: মো. হারুণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ভয়াবহতার খবর পেয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করতে মাইলের পর মাইল পাহাড়ী পথে হেঁটে প্রশিক্ষণে যান তিনি। যুদ্ধে জীবন বিপন্ন হয়ে যাওয়ার কথা শুনেও তিনি যুদ্ধে অংশ নেন।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছর পার হলেও তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়েও পাননি তিনি। অভাব-অনটনে তাঁর দিন কেটেছে, মৃত্যুর আগে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি।
মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর শেষ বিদায়ে গার্ড অব অনার দেয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু মো. হারুনের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম না থাকায় রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার পাননি। তবে সরকারি গার্ড অব অনার না পেলেও গ্রামবাসী জানাজার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানিয়েছেন তাকে, স্যালুট জানিয়েছেন, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
১৮ এপ্রিল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার সৈয়দবাড়ি এলাকায় মো. হারুন (৭৩)কে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী শ্রদ্ধা শেষে জানাজার পর দাফন করা হয়। এসময় রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
আগের দিন বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
জানাজায় অংশ নেয়া কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মে মাসে রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এমন তান্ডবের খবর পেয়ে বাড়ি থেকে প্রশিক্ষণের জন্য বের হয়ে যান হারুন। ওই মাসেই রাঙামাটির রাজস্থলী হয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চল মেঘালয় রাজ্যের দেমাগিরি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করেন তিনি। এক মাস প্রশিক্ষণ শেষ করে ১ নম্বর সেক্টরের অধীন ভারতীয় মেজর সোহানের নেতৃত্বে ভুটান ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ৪টি গ্রুপ রাইফেল, বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলা বারুদ নিয়ে গাইডার হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।
প্রথম অপারেশনটি করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জালিয়া পাড়া, দ্বিতীয় অপারেশন যক্ষা বাজা, তৃতীয় অপারেশন আয়না ছড়া ও চতুর্থ অপারেশন হয় বরকলে। বরকলে ১ হাজার ৭০০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পে আক্রমণ করেন হারুনসহ কয়েকজন। এরপর রাঙামাটির কাপ্তাই হয়ে নিজ এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় চলে আসেন। রাঙ্গুনিয়া কলেজের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সংশ্লিষ্ট মেজর ও সেনাদলসহ যোগ দেন হারুন। এলাকায় ছোটখাট অপারেশন চালান তিনি। স্বাধীনতার এত বছর পরও স্বীকৃতি না পেয়ে খুব আক্ষেপ ছিল তাঁর। মৃত্যুর আগে অন্তত স্বীকৃতি পাবেন সেই আশাও ছিল তাঁর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তিনি পাননি।
জানাজায় অংশ নেয়া একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হারুনের সাথে একাত্তরে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে দেমাগিরি এলাকায় প্রশিক্ষণের সময় দেখা হয়। পরে ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মেজর সোহানের সাথে গাইডার হিসেবে রাঙ্গুনিয়া কলেজ ক্যাম্পে আসেন তিনি। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার অর্ধ শত বছর পার হলেও প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাননি। এমনই এক মুক্তিযোদ্ধা হারুন। টাকা-পয়সা না থাকায় তিনি শেষ বয়সেও স্বীকৃতি পাননি। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। হারুনের মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না পেয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন, কষ্টে জীবন পার করছেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না পেয়ে অনেকটা মনোকষ্ট নিয়ে নীরবে চলে গেছেন হারুন। গ্রামের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাকে আমরা স্যালুট জানিয়ে শেষ বিদায় দিয়েছি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার খায়রুল বশর মুন্সি বলেন, ‘হারুন একাত্তরে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন। সনদ না থাকায় তাঁর স্বীকৃতি মিলেনি। তাঁর স্বীকৃতির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি।’
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available