জহিরুল ইসলাম টিটু, লক্ষীপুর প্রতিনিধি: লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে বাংলাদেশের প্রথম মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অবস্থান। সরকারী এ প্রতিষ্ঠানটি নামে সরকারি হলেও সরকারি কোন আইনের তোয়াক্কা করেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে এখানকার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে। মাছের পোনা কিনতে আসা ক্রেতাদের সাথে দূব্যবহার, রেনু পোনা বিক্রির ক্ষেত্রে ওজনে কম দেয়া, প্রজনন কেন্দ্রের কমকর্তা-কর্মচারিদের সাথে দূব্যবহারসহ গুরুতর সব অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রেনু ও পোনা কিনতে আসা ক্রেতাদের সাথে কোন কারণ ছাড়াই দূব্যবহার করেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লুৎফুর রহমান। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে এক কর্মচারির কাজ অন্যকে দিয়ে করানোর। ক্রেতাদের ওজনে কম দেয়া , কর্মচারীদের একজনের নামে বরাদ্দকৃত বাসা অন্যজনকে বরাদ্দ দেয়া, মাস্টাররোল কর্মচারিদের উসকেদিয়ে তার অপছন্দের স্থায়ী কর্মচারীদেরকে দমন করানো, ইচ্ছেকরে অতিরিক্ত চুন প্রয়োগ করিয়ে মা মাছ মেরে বাইরে বিক্রি করাসহ বিস্তর অভিযোগ।
অভিযোগের ব্যাপারে কথা হয় রায়পুরা মৎস প্রজনন কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দীনের সাথে। তিনি জানান, রেনু পোনা বিক্রির সময় ওজনে কম দেয়ার প্রতিবাদ করায় লুৎফুর রহমান সাহেব আমার সাথে খারাপ আচরণ করেন। মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান বলেন, স্যার বলে সম্বোধন না করায় আমার সাথে অশালীন আচরণ করেছেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লুৎফুর রহমান। কথা হয় প্রজনন কেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরী মো. সুমনের সাথে। তিনি বলেন, আমার নামে বাসা বরাদ্দ হলেও আমি সে বাসায় উঠতে পারছিনা। ২০১৫ সালে অবসরে যাওয়া নিরাপত্তা প্রহরী মো. মফিজ মজুমদারকে আমার নামে বরাদ্দকৃত বাসা এখনও বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। কথা হয় মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রের হিসাবরক্ষক মো. আবদুর রহিমের সাথে। তিনি বলেন, লুৎফুর রহমান সাহেব এখানে যোগ দেয়ার পর আমাকে হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে এখন নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করাচ্ছে। লুৎফুর রহমান সাহেব তার পছন্দের একজনকে হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে বসিয়েছে। এছাড়া আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সরিয়ে দিয়ে লুৎফুর রহমান মাষ্টাররোলে থাকা এক কর্মচারী আবুল কাশেমকে দিয়ে রেনু পোনার ওজন পরিমাপ করাচ্ছেন। অভিযোগ আছে ঐ আবুল কাশেমের বিরুদ্ধেও। সে ওজনে গড়বড় করে রায়পুরে অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করে পৌর শহরে জমি কিনেছে, বানিয়েছে বাড়ি। প্রতিবেদকে দেখে পালিয়ে যাওয়ায় তার প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয়নি।
মুঠোফোনে কথা হয় মাস্টাররোলে কাজ করা কর্মচারী মো. কবির হোসেন ও মো. হান্নানের সাথে। তারা অভিযোগ করে বলেন, লুৎফুর রহমানের অত্যাচারে এক বছড় আগে বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দেশের বাইরে চলে আসি। ওনার আন্ডারে চাকরি করা সম্ভব না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানান, রাতের আঁধারে লুৎফুর রহমান তার পছন্দের লোক মফিজ মজুমদারকে দিয়ে মা মাছের পুকুরে অতিরিক্ত চুন প্রয়োগ করান। সকালে ঐ পুকুরের মাছ মরে ভেসে উঠলে মফিজকে দিয়ে বাইরে বিক্রি করান।
অভিযোগ করেন কক্সবাজারের চকোরিয়ার মৎস চাষী আশ্রাফ হোসেন। তিনি বলেন, আমাকে রেনু পোনা পরিমানে কম দেয়ায় আমি প্রতিবাদ করি । এ সময় লুৎফর রহমান সাহেব আমাকে অপদস্ত করে। অভিযোগ করেন ফেনির লস্কর হাটের মো. সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, আমাকে চাহিদামত রেনুপোনা তো দিতেই পারেনি তার উপর খুবেই বাজে আচরন করেছে ঐ সরকারি কর্মকর্তা। ফরিদগঞ্জের আবদুল মান্নান নামের একজন ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, রেনু পোনার জন্য ৫ বার গেলেও আমাকে রেনুপোনা দেয়নি। একবারতো আমাকে অফিস থেকে বেরই করে দিয়েছে। চাটখিলের একজন ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, মৎস প্রজনন ও প্রশিক্ষন কেন্দ্রের ওয়াল নিয়ে কথোপকথনের একপর্যায়ে স্থানীয় দুজন কাউন্সিলর এবং আমার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন লুৎফর রহমান সাহেব।
১ জুন বৃহস্পতিবার সকালে সরজমিনে রায়পুর উপজেলা মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী একটি বেসরকারি হ্যাচারি পরিদর্শন করে এশিয়ান টিভি অনলাইনের লক্ষীপুর প্রতিনিধি। তিনি দেখতে পান সেখানে মাছের পোন গুনছেন এক ব্যক্তি। তাকে প্রশ্ন করা হয়- এ পোনা কোথা থেকে পেয়েছেন? জবাবে নাম প্রকাম না করার শর্তে ঐ ব্যক্তি বলেন, -‘ভাই আম্নেরাতো জানেনই আমরা সিস্টেমে অল্প কোগা করি মাছ আনি ভিত্তেত্তন’(ভাই আপনারাতো জানেনই আমরা সিস্টেমে রায়পুর উপজেলা মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভেতর থেকে কিছু কিছু মাছ নিয়ে আসি এবং বিক্রি করি)
অভিযোগ আছে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সাথে খারাপ আচরন করার। জানা যায়, একবার গেস্টহাউজ ভাড়া চাইলে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লুৎফুর রহমান তার সাথে অশালীন আচরণ করেন।
২১ দশমিক ৮৩ হেক্টর আয়তনের রায়পুর উপজেলা মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিক উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। এখানে মোট পুকুরের সংখ্যা ৭৫ টি। এ প্রশিক্ষন কেন্দ্রে ৮৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৩০ জন। শূন্য পদ রয়েছে প্রায় ৫৩ টি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর চট্রগ্রামের পটিয়া থেকে রায়পুর উপজেলা মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন লুৎফুর রহমান। যোগদানের পর থেকেই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা এবং প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী তার অসৌজন্যমূলক আচরণের কারনে ক্ষিপ্ত। তার এমন স্বেচ্ছাচারী আচরণের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত একাধিক কর্মচারী চাকুরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। কেউবা আবার পাড়ি জমিয়েছেন প্রবাসে।
এমন সব ভয়াবহ অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানতে চাওয়া হয় রায়পুর উপজেলা মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. লুৎফুর রহমানের কাছে। এ সময় অভিযোগের বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available