বিপ্লব তালুকদার, খাগড়াছড়ি: উঁচু নিরেট প্লাটফর্মের ওপরে বাঁশের বেড়া। মাথায় টিনের চালা। জানালাগুলো কাঠের। টিনের রঙচটা চাল আর বাঁশের বিবর্ণ বেড়ায় বয়সের ছাপ। এমন দৃশ্যই চোখে পড়বে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে মং সার্কেল চিফের প্রাচীন রাজবাড়িতে গেলে।
উত্তর থেকে এসে পশ্চিম ঘুরে দক্ষিণে কুল কুল করে বইছে মানিকছড়ি খাল। পাহাড় ধোয়া পানির স্রোত ঠিক যেন বেড় দিয়ে রেখেছে রাজবাড়িকে। যেনো রাজবাড়িকে আগলে রাখতেই এখানে অনেকটা কলসির আকার নিয়েছে মানিকছড়ি খাল।
খালের ওপরে বাঁশের সাঁকো। খাল আর রাজবাড়ির মাঝখানে সবুজ চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাল শূকর। ছাগলগুলোর সঙ্গে কী দারুণ সখ্য তাদের!
ভেতরের চত্বরের ঠিক মাঝখানে পাকা কাচারি ঘরটি পরিত্যক্ত। চারিদিকেই খোলা দরোজার খিলান, দেওয়াল আর নকশায় উপমহাদেশীয় রাজকীয় স্থাপনার আভিজাত্যের চিত্র। ভর দুপুরে সেখানে জমে উঠে পাড়ার যুবকদের অলস আড্ডা। রাজ জেতবন বৌদ্ধ বিহারের সামনে যেনো প্রহরা বসিয়েছে হা মেলা দুই বাঘের মূর্তি।
বৈঠকখানার সামনের দেওয়ালে দু’পাশে তামার তৈরি দুই রাকজীয় সিলমোহর। তাতে ময়ূরের দুই প্রতিকৃতির পায়ের সঙ্গে খোলা তলোয়ার। তার নিচে চক্র। মং রাজা কথাটিও লেখা আছে সিলমোহরের উপরের অংশে। সিলমোহরের তামাটে শরীর কী দারুণ চকচকে এখনো।
এই রাজবাড়ির চত্বর জুড়েই রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালির অবারিত উপস্থিতি। মূল ফটকের দু’পাশে অভ্যাগতদের স্বাগত জানাতেই যেনো দাঁড়িয়ে আছে নারকেল আর সুপারি গাছের সারি। মাথা দোলাচ্ছে বাতাসে। আছে জাম বাগান, কাঁঠালী চাপার বয়সী শরীর। একটা বাঁশবন আর কচুক্ষেতও চোখে পড়লো কোনায়।
খাগড়াছড়িতে মং রাজবংশের উত্থান সেই কংজয়ের আমল থেকেই। ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃষ্টিতেই মূলত রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় কংজয়ের। ত্রিপুরা রাজকন্যা চন্দ্রাকে বিয়ে করেন কংজয়। তারপর এই মানিকছড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন। কয়েক দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে এখানে শাসনকাজ চালান তিনি ও তার বংশধরেরা।
কংজয়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র কিউজা যখন বাবার স্থলাভিষিক্ত হন তখন তিনি নিতান্তই নাবালক। বয়স মাত্র সাত বছর। প্রয়োজনের তাগিদেই তাই মাথার ওপর ছায়া হয়ে আসেন কাকা লথানয্যা। ১৮৪০ সাল অবধি কাকার অভিভাবকত্বে থেকেই রাজ্য পরিচালনা করেন কিউজা।
শুর থেকেই ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিলো তার। ১৮৬১ সালে কুকি দমনেও ইংরেজদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন কিউজা। প্রতিদান হিসেবে তাকেই মং সার্কেলের চিফ করা হয়। এই কিউজাই প্রথম মং সার্কেল চিফ। মানিকছড়ির এই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
এরপর নরপদি, কিউজা প্রু, নে প্রু সেইন, রানী নানুমা, রাজা মং প্রু সেইন, নিহার দেবী, প্রাইহলা প্রু পর্যায়ক্রমে মং সার্কেল প্রধান হন।
এদের মধ্যে নে প্রু সেইনের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তার একমাত্র কন্যা নানুমাকে সহকারী মং চিফ হিসেবে নিয়োগ দেয় ব্রিটিশরা।
নানুমার সময়ে ১৯০২ সালে তৈরি হয় কাচারি। বৈঠক ঘরটা বোধহয় বয়সে আরো নবীন। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে সোজা পথে কিছুটা হাঁটলে প্রথমে ডানে বৈঠকখানা, তারপর বাঁয়ে কাচারি ঘর, শেষে হাতের ডানে পড়বে বেড়ার ঘর। চত্বর জুড়ে সবুজ আর সবুজ।
মং রাজবংশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতিধন্য এই রাজবাড়ির অবস্থান চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি রোডের ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে। চট্টগ্রাম থেকে এখানকার দূরত্ব মোটে ৫৩ কিলোমিটার। আর খাগড়াছড়ি থেকে এর চেয়ে এক কি দু’কিলোমিটার বেশি। ঢাকা থেকে এখানকার দূরত্ব সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটারের মতো।
মহাসড়ক থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরের দিকে গেলে মানিকছড়ি বাজারের এক কোণায় এই রাজবাড়ির অবস্থান। সামনের বাজারটাও ঘুরে বেড়ানো যায় মিনিট পনেরো সময়ে। বাংলাদেশের বিখ্যাত ফুলের ঝাড়ুর অন্যতম বাজার এই মানিকছড়িতে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available