মেহেরপুর প্রতিনিধি: মেহেরপুর শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিক ডা. রমেশ ক্লিনিকে এপেন্ডিক্স অপারেশনের পর স্বর্ণালী খাতুন নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। স্বর্ণালী ঐ ক্লিনিকেরই সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার পর রোগীর আত্মীয়-স্বজন ক্লিনিক ঘেরাও করে হামলার চেষ্টা করলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে।
নিহত স্বর্ণালী মেহেরপুর পৌর এলাকার হোটেল বাজার পাড়ার মৃত আদম শেখের মেয়ে এবং মেহেরপুর মল্লিকপাড়ার সাদ্দামের স্ত্রী।
২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে মেহেরপুর পৌর এলাকার মল্লিক পাড়ার রমেশ ক্লিনিকে বহিরাগত চিকিৎসক মস্তফা কামাল জাহিদের পরামর্শে এপেন্ডিক্সের অস্ত্রপচার করা হয় সেখানকারই কর্তব্যরত সিনিয়র নার্স স্বর্ণালী খাতুনের। কিন্তু অপারেশন শেষে পোস্ট অপারেটিভ বেডে নিতেই স্বর্ণালীর কার্ডিয়াক এরেস্ট হলে তাকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয় বলে জানায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টায় অবস্থার উন্নতি না হলে রমেশ ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করে। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ঢাকায় নেওয়ার পথে পথিমধ্যে তার মৃত্যু ঘটে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস যাবৎ স্বর্ণালী পেট ব্যাথায় ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার ওটিতে চিকিৎসকদের সাথে চারটি অস্ত্রোপচারে অংশ নেওয়ার পর ক্লিনিকে আসা বহিরাগত চিকিৎসক মোস্তফা কামাল জাহিদকে স্বর্ণালীর সমস্যার কথা জানালে চিকিৎসক তাকে অস্ত্রপচারের পরামর্শ দেন। স্বর্ণালীর স্বজনদের না জানিয়েই কোনরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ক্লিনিকে তার এপেন্ডিক্স অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে তার চেতনা না ফেরাতে এলাকায় স্বর্ণালীর মৃত্যু হয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত জনতা ক্লিনিক ঘেরাও করে। সেসময় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তার স্বামী সাদ্দামের কাছ থেকে বন্ডে স্বাক্ষর নেয় (যা নিয়মানুযায়ী অস্ত্রোপচারের আগে নেওয়ার কথা) এবং মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করে।
নিহতের মামাতো ভাই রুবেল অভিযোগ করে অপারেশনের রাতে বলেন, ‘আমার বোনের অপারেশনের সময় ডাক্তার ছিলো না। হাসপাতালের কর্মচারী হাবিব এনেস্থেশিয়া করেছে। আর ম্যানেজার শহিদুল অপারেশন করেছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শিলন বলেন, বৃহস্পতিবার আমার সামনেই ডা. মেহেদী হাসান বলেছিলেন, এনেস্থেশিয়া ইনজেকশন হাবিব দিয়েছে।’
নিহত স্বর্ণালী দেবর সায়ন বলেন, ‘পরিবারের লোকদের না জানিয়ে এবং কোনরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া কিভাবে তারা অপারেশন করলো সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। আমি কোনদিন শুনি নাই যে, এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করতে যেয়ে রোগী মারা যায়। তদন্তসহ এই ঘটনার বিচার দাবি করছি। ‘
২৩ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকাল পৌনে চারটায় স্বর্ণালীর মরদেহ মেহেরপুর এসে পৌঁছালে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ও ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেওয়ার দাবি জানায়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশের অনুরোধে মেহেরপুর পৌর মেয়র ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ মৃতের স্বজনরা আলোচনায় বসে এবং ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ মৃতের পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘটনার মীমাংসা করে বলে জানা গেছে।
অর্ণব, রুবেল, ইমনসহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, গত দুই মাসে এ নিয়ে রমেশ ক্লিনিকে তিনজন রোগী কর্তৃপক্ষের অবহেলায় অপারেশন টেবিলেই প্রাণ হারিয়েছেন এবং এ বছরে মোট পাঁচ জন মারা গেছেন। ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয়া উচিত।
এনেস্থেশিয়ার চিকিৎসক ডা. মেহেদী হাসান ঘটনার রাতে বলেছিলেন, তার পরিবর্তে ঐ ক্লিনিকের এক কর্মচারী হাবিব স্বর্ণালীর এনেস্থেশিয়া করেছিলো। এ বিষয়ে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হতে সরাসরি ও ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও ডা. মেহেদী হাসানের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।
মেহেরপুর পৌর ৭ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার নুরুল আশরাফ রাজিব মুঠোফোনে জানান, বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন। তিনি বলেন, ‘শুধু রমেশ ক্লিনিকেই নয় মেহেরপুর শহরের অন্যান্য ক্লিনিকেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ভুল চিকিৎসা অথবা চিকিৎসাজনিত অবহেলায় রোগীর মৃত্যু ঘটছে আর পরবর্তীতে রোগীর স্বজনদের সাথে আর্থিক বিনিময় করে ঘটনার মিমাংসা করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ধরনের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত যারা তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।’
অস্ত্রোপচার ও পরবর্তী ঘটনা পরিক্রমাসহ আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হতে ড. রমেশ ক্লিনিকের ম্যানেজার শহিদুল ইসলামকে বার বার মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ক্লিনিকে গেলে বলা হয় তিনি বাইরে আছেন।
মেহেরপুর ২৫০ শহর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জমির মোহাম্মদ হাসিবুস সাত্তার বলেন, অস্ত্রোপচারের সময়েই মূলত রোগী কোমাতে চলে গেছিলো। মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে স্বর্ণালীর ফুসফুসটি সচল রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধে শুক্রবার দিবাগত রাত চারটার সময় রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাতে রেফার্ড করা হয়।
মেহেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী বলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে আমি অবগত আছি। কেউ অভিযোগ দিলে তদন্ত সাপেক্ষে ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেহেরপুর সদর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ সচেষ্ট ছিলাম। ঘটনার দিন থেকেই পরিবারের সদস্যদের বলা হয়েছে অভিযোগ দিতে, কিন্তু তারা কোন অভিযোগ দেননি। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেয়া হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন আর্থিক লেনদেন হয়েছে কিনা এ প্রশ্ন করলে ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাইরে অবস্থান করছিলাম। লেনদেন হয়েছে এমন একটা কথা শুনেছি। তবে সঠিক তথ্য আমার জানা নাই।
তবে মীমাংসাকারী মেহেরপুর পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটন, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রসুলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তারা কিছুই বলতে রাজি হননি।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available