নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রক্রিয়াধীন মেডিকেল অফিসার, কনসালটেন্ট, সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ সকল নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তৃতীয় দফায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এবং সুপারিশের ভিত্তিতে পুরো নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিএসএমএমইউয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৩ জুলাই সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের শূন্য পদে জনবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে ৫২ পদে ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। পদগুলোর মধ্যে কনসালট্যান্ট পদে ৯৬ জন, মেডিকেল অফিসার (মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিকস) পদে ৬০ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে ২২৫ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়। এ ছাড়াও এই বিজ্ঞপ্তিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ), পরিচালক (আইটি), টেকনিশিয়ান, টেকনোলজিস্টসহ সবমিলিয়ে ৫৪৪ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়।
এরপর ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৮ ক্যাটাগরির পদে ৪র্থ থেকে ৯ম গ্রেডে ১৭২ জন জনবল নিয়োগে পুনর্বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ৬৮টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতা চাওয়া হয় বিএমডিসি কর্তৃক স্বীকৃত এমবিবিএস বা সমমান ডিগ্রি এবং বিএমডিসি কর্তৃক স্থায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত।
এ ছাড়াও এই বিজ্ঞপ্তিতে বিভাগীয় প্রার্থী ও বিএসএমএমইউ থেকে প্রাপ্ত পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সের সময়সীমা রাখা হয় অনূর্ধ্ব ৩২ বছর পর্যন্ত। তবে বিভাগীয় ও অভিজ্ঞ প্রার্থীর ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্য বলেও উল্লেখ করা হয়, যার বেতন স্কেল হবে ২২,০০০-৫৩,০৬০ টাকা (গ্রেড-৯)।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৬৮ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিতে সে বছরেই (২০ অক্টোবর) লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২১ অক্টোবর রাত ৮টার পর। তবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন সবকিছুতেই বড় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এমনকি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনাও ঘটে বলে দাবি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএমএমইউ কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির সদস্য বলেন, দুই দফায় তদন্ত শেষে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন প্রশাসন আবারও তদন্তের উদ্যোগ নেয়। পূর্ববর্তী তদন্ত কমিটিগুলোর প্রতিবেদন, তথ্য-প্রমাণসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এতো বড় অনিয়ম আর হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন হলে সকল সিন্ডিকেট সদস্যও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
তিনি বলেন, তদন্তে আমরা পূর্ববর্তী রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করেছি। এমনকি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমরা, অনিয়মের সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছি। যেখানে কল রেকর্ড ছিল, সিসিটিভি ফুটেজ ছিল, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনের স্ক্রিনশট ছিল, পেনড্রাইভে প্রশ্ন নেওয়া অভিযুক্ত চিকিৎসকের মিষ্টি বিতরণের ছবিসহ আরও অনেককিছু যাচাই-বাছাই করেছি। সবমিলিয়ে তদন্ত কমিটির প্রত্যেকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলের সুপারিশ করেছি।
বিএসএমএমইউ প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ বলেন, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যে প্রশাসন এসেছে, আমরা চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। ইতিমধ্যে আমরা বিগত সময়ের সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের ওপর হামলা ঘটনায় তদন্ত করে মামলা করেছি। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজন প্রীতি, টেন্ডারবাজি, এগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বেশ কিছু তদন্ত কমিটি করেছে। এমনকি সেগুলোর তদন্ত রিপোর্ট একের পর এক আমাদের হাতে আসতে শুরু করেছে। এসবের ওপর নির্ভর করে আমাদের পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, যদি এই সংস্কারগুলো করতে পারি, সকল অনিয়ম-দুর্নীতির মূল হোতাদের যদি আইনের আওতায় আনতে পারি, তাহলে আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসবে।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, আজ আমাদের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভা ছিল। সভায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের সময়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এমনকি গত ১৫ বছরে চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈষম্যের বিষয়ও এসেছে। সে অনুযায়ী সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শিক্ষা-চিকিৎসায় বিশ্ববিদ্যালয়টির হারানো গৌরব আবারও ফিরিয়ে আনতে পারবো।
নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ড. শারফুদ্দিন সাহেবের সময়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়োগ বাণিজ্য এবং পরীক্ষায় অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলো নিয়ে পরবর্তী ভিসির (দীন মো. নূরুল হক) সময়েই দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্রথম তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দ্বিতীয় তদন্তে অস্পষ্টতা আছে বলে জানানো হয়। তাই আমর এসেই নতুন করে আবারও তদন্ত কমিটি গঠন করি। সেই তদন্ত কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে আজ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে এবং আমরা তাদের সুপারিশ অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
অভিযোগ রয়েছে, পেনড্রাইভে করে ৩০০ প্রশ্ন চুরি করে সেগুলো ফাঁস চক্রের সদস্যদের কাছে সরবরাহ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহিদুল ইসলাম ও কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফয়সাল ইবনে কবির। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তারাই চাকরি প্রত্যাশীদের কাছে তা বিক্রি করেন। এই চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন— সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন, একই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. জাহিদ হাসান পলাশ, বিএসএমএমইউর নিউরো সার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. আবেদ আব্বাস, কনজারভেটিভ ডেনটিস্ট বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মোমিনুর রহমান ও ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাঈনুল মাহমুদ সানী।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০ অক্টোবরের লিখিত পরীক্ষায় যেসব চিকিৎসক উত্তীর্ণ হন, তাদের মধ্য থেকে যারা নিয়োগের জন্য আর্থিক লেনদেন করেছিলেন, ২৬ অক্টোবর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের তৎকালীন অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন তাদের মিষ্টিমুখ করান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পেনড্রাইভে প্রশ্ন নেওয়া ডা. ফয়সাল ইবনে কবির।
এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাসুম আলম এবং প্রশ্ন বিক্রি চক্রের সদস্য ডা. আবেদ আব্বাস, ডা. মোমিনুর রহমান, ডা. মাঈনুল মাহমুদ সানী, ডা. জাহিদ হাসান পলাশ। তাদের সঙ্গে মিষ্টি খান চাকরিপ্রত্যাশী ডা. অনুপম সাহা, ডা. রাব্বী হাসান, ডা. সানাহউল্লাহ মোল্লা স্বপন, ডা. জুনায়েদ আহমেদ, ডা. সর্বজিত রায়, ডা. তনুময় দত্ত রায়, ডা. আরিফুর রহমান শাওয়ান, ডা. আদনান ইবরাহিম, ডা. দাউদ চৌধুরী পলাশ, ডা. জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ, ডা. মাইদুল ইসলাম, ডা. আবু বকর সিদ্দিক লিমন, ডা. নাফিস রায়হান, ডা. আতিকুর রহমান মিজু প্রমুখ।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রশ্নফাঁসে জড়িত দুই মেডিকেল অফিসার ডা. আবেদ আব্বাসের স্ত্রী ডা. উম্মে হাবিবা শান্তা, মেডিকেল অফিসার ডা. মোমিনুর রহমানের স্ত্রী ডা. মাহিরুন নাহার অরিনও।
মেডিকেল অফিসার নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটা অংশ গত বছরের ২৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম সালেককে সদস্য সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তবে সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগে বলা হয়, লিখিত পরীক্ষায় কাদের উত্তীর্ণ করা হবে তা আগেই চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছিল এবং সেই তালিকা অনুযায়ী মনোনীত প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষার আগেই নিজ কক্ষে ডেকে মিষ্টিমুখ করান সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন।
শিক্ষার্থীদের দাবি, পরীক্ষা কেন্দ্রে অনুপস্থিত থেকেও চূড়ান্ত মেধাক্রমে ৫০৩১৫ রোলধারী এক প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন।
এ বিষয়ে তৎকালীন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বিএসএমএমইউ শাখার সদস্য সচিব অধ্যাপক মো. আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার টিটো বলেন, বিএসএমএমইউয়ে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশকিছু কল রেকর্ড, সিসিটিভি ফুটেজ আমরা দেখেছি। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে মনে হয় নিয়োগ নিয়ে অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে। আমরা চাই সবকিছু স্বচ্ছ ও সঠিক হোক। এখন যেহেতু তদন্ত কমিটি হয়েছে, প্রতিবেদন সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তটাই যেন নেওয়া হয়।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available