মো. বকুল আলী: আমাদের দেশে কোথাও গাছ কাটা হলে তার কৈফিয়ত স্বরূপ বলা হয় সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প হবে কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। জাতিসংঘের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান (ইউএনআইটিআর) দুর্যোগকে ৪টি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনাঞ্চল ধ্বংস, পরিবেশ দূষণ প্রভৃতি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বৃহৎ এলাকার গাছপালা কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। শরীয়তপুর জেলার ছয়টি উপজেলায় চলতি অর্থবছরে ১৯ কিলোমিটার সড়কের পাশ থেকে ১৭০০ গাছ কেটেছে বন বিভাগ। গত মে মাসের শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আমনুরা ঝিলিম বাজারে সড়কের একপাশে ২৫০ মিটারের ড্রেন নির্মাণের জন্য সড়কের দুইপাশের ২ কিলোমিটারে ২৫৮টি গাছ কাটা হয়েছে। অথচ, উচিত ছিল বৃক্ষনিধন না করে বিকল্প উপায়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে অপরিকল্পিত নগরায়ন একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। আর এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ফলে আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হবো। চলতি বছরে তীব্র তাপদাহ আমাদের কর্ণকুহরে সেই বার্তাই উঁকি দিচ্ছে।
বৃক্ষের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তুলতে হবে
একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তার আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অধিকিন্তু দিন দিন অযাচিতভাবে আরও বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। ফলে দেশের পরিবেশের ভারসাম্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের গাছের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমরা যেমন মা-বাবা, ভাই-বোনকে ভালোবাসি তেমনি গাছকে আপন করে নিতে হবে। কোনো শত্রুর আক্রমণে আমরা যেমন মা-বাবা, ভাই-বোনকে রক্ষায় এগিয়ে আসি, তেমনি গাছপালা রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। তাহলে গাছপালার গায়ে নিজেও সহজে কুঠার তুলতে পারব না, অন্যরা গাছ কাটলে তার তীব্র প্রতিবাদ করতে পারব। আমাদের ভালোবাসার আচ্ছাদনে গাছপালা সুরক্ষিত হবে।
পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন গাছ অপসারণ করতে হবে
ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, বোতলব্রাশ প্রভৃতি গাছ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। একটি ইউক্যালিপটাস গাছের শিকড় মাটির ১৫ মিটার গভীরে থাকে। পানি ও খনিজ লবণ শোষণ ছাড়াও অতিরিক্ত পানি শুষে ডালপালায় জমা রাখে। ফলে যে স্থানে গাছটি লাগানো হয়,সে স্থানটি পানিশূন্য হয়ে পড়ে ও উর্বরতা শক্তি কমে যায়। এছাড়াও এর ডালপালাগুলো জমিতে পড়লে জৈব সারের পরিবর্তে অজৈব/রাসায়নিক পদার্থের মতো কৃষিজমিকে অনুর্বর করে। আকাশমণি, বোতলব্রাশ প্রভৃতি গাছের পরাগরেণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে গত ডিসেম্বরে ঢাকা নগরের রমনাপার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, এসব এলাকার ৫৮ শতাংশ গাছই বিদেশি প্রজাতির এবং শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ আছে ৩৩ শতাংশ। এসব গাছ অনেকাংশে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশ সুন্দর, নির্মল রাখতে ঔষধি, বনজ ও ফলজ প্রজাতির গাছ যেমন- নিম, শাল, বহেরা, অশোক, জারুল, হরিতকী, জাম প্রভৃতি গাছ লাগাতে হবে।
পরিকল্পনা বিভাগে পরিবেশবিদ নিয়োগ জরুরি
রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে গাছ কাটার প্রতিবাদ করা হলে বলা হয়, পরিকল্পনা শাখা, জেলা পরিষদের অনুমতি নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বিভাগে প্রকৌশলী যেমন প্রয়োজন, তেমনি পরিবেশবিদও প্রয়োজন। একজন পরিবেশবিদ ভালো জানেন কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি না করে অবকাঠামো নির্মাণ করা যায় এবং কোনো অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আশেপাশের পরিবেশ কীভাবে গাছপালা দিয়ে ভরিয়ে তোলা যায়। তাই, পরিকল্পনা বিভাগে প্রয়োজন মতো পরিবেশবিদ নিয়োগ করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক।
বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষের পরিচর্যা করতে হবে
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ সরকারি কর্মজীবী রয়েছেন। যদি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন পরিকল্পনা করা হয় যে, প্রত্যেক সরকারি চাকরিজীবীকে কমপক্ষে ৩টি গাছ লাগাতে হবে এবং সেই গাছগুলোর পরিচর্যাসহ প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রদান করতে হবে। তাহলে শুধুমাত্র সরকারি কর্মজীবীদের দ্বারাই দেশের মাটিতে কমপক্ষে সাড়ে ৪৫ লাখ গাছ লাগানো সম্ভব। এতে যেমন গাছপালা বৃদ্ধি পাবে তেমনি উনাদের গাছের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। ফলে সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে উনাদের পরিবেশের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিবছর যথেষ্ট বৃক্ষরোপণ করা হয়। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার অভাবে সেগুলো দেশের মাটিতে আলোর মুখ দেখে না। বৃক্ষরোপণ যেমন জরুরি বৃক্ষের পরিচর্যা তেমনি জরুরি। যেমন- নিয়মিত পানি দেয়া, খুঁটি দেয়া, জৈব সার প্রয়োগ, গরু-ছাগল থেকে রক্ষার জন্য বেড়া দেওয়া জরুরি ইত্যাদি কাজ অবশ্যই করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়,ব্যক্তি উদ্যোগে বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণ ও সেগুলোর পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে তুললেই সবুজ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব।
লেখক: সভাপতি, গ্রীণ ভয়েস, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available