আবু সালেহ্ : উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দেশের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখেছে এ কলেজ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে সংঘটিত গণআন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ। এই আন্দোলনে ঢাকা কলেজ এক গৌরবগাঁথা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা কলেজ ছিল পুরান ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিক বাজার এলাকায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে একই দিনে রাষ্ট্রভাষাকে বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে ছাত্ররা কলেজের অনুষ্ঠানকে বয়কট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে বিচ্ছিনভাবে যোগদান করে।
একই দিনে আবার প্রাদেশিক আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন ছিল। এ অধিবেশনটি জগন্নাথ হলের মিলনায়তনে বসেছিল। সাধারণ ছাত্ররা মিছিল নিয়ে হলের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় এবং হামলা চালায়। ছাত্ররা এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এর প্রেক্ষিতে পুলিশ নির্বিচারে ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই জব্বার, রফিকসহ ৪ জন নিহত হন এবং অনেকেই আহত হন।
এ খবর সবদিকে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে তৎকালীন সরকার কারফিউ জারি করে।
ঢাকা কলেজের তৎকালীন দর্শন বিভাগের শিক্ষক সাইদুর রহমান তার এক বইতে লিখেছেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন সাধারণ ছাত্ররা ধর্মঘট ডাকার কারণে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুকূল অবস্থা আর ছিল না। ছাত্ররা খেলাধুলার বদলে সেদিন ধর্মঘট সফল করার জন্য ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে গিয়েছিল।’
সেদিনের ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র ইকবাল আনসারী খান। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পরিকল্পনা হলে ওই সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দলের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ছিলেন ইকবাল আনসারী খান। মিছিল শুরুর কিছু সময় পরেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজের মেইন হোস্টেল ছিল বেগমবাজার এলাকার হাসিনবাগ, মোস্তফা হাউস এবং নুপুর ভিলায়। একই সময়ে ঢাকা কলেজের ওই হোস্টেলের সুপার ছিলেন দর্শন বিভাগের শিক্ষক সাইদুর রহমান। উত্তপ্ত পরিবেশের মধ্যে যখন চারদিকে ধরপাকড় শুরু হয়েছে তখন ছাত্রনেতা মতিনসহ আরও বেশ কয়েকজনকে লুকিয়ে রাখেন শিক্ষক সাইদুর রহমান। ছাত্রদেরকে তার ৩৭, বেচারাম দেউরির বাসায় নিরাপদে রাখেন।
শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলা ও নৃশংসতার প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার যে পরিকল্পনা তা করা হয় ঢাকা কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমানের বাসাতেই।
২১ ফেব্রুয়ারি আসলে আমাদের মনে পড়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। বিখ্যাত এই গানটিও এই বাসাতে আত্মগোপনে থাকার সময় আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী রচনা করেছেন।
গানটি টাইপ করা হয় ঢাকা কলেজের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে আর টাইপের কাজটি করেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন ছাত্র দেশবরেণ্য সাংবাদিক শফিক রেহমান।
অধ্যক্ষের অনুমতি সাপেক্ষ ঢাকা কলেজের সাইক্লোস্টাইল মেশিন ৩৭ নম্বর বেচারাম দেউরিতে নিয়ে লিফলেট ছাপানো হয়। আর লিফলেট ছাপানোর জন্য চাঁদাও সংগ্রহ করা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজে রাখা হয়েছিল। খবর পেয়ে তাদের দেখতে গিয়েছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী। হাসপাতালের আউটডোরের বারান্দায় ফ্লোরে শহীদ রফিকের লাশটি রাখা ছিল। গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে গেছে। এ মৃতদেহটি দেখেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতাটি লেখেন বিখ্যাত এই ব্যক্তি।
সময়টা ছিল ১৯৫৩ ল্যাবরেটরি ক্লাস করার জন্য ইডেন কলেজের ছাত্রীরা ঢাকা কলেজে নিয়মিত আসতো। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম ভাষা শহীদ দিবস ছিল। প্রথম ভাষা শহীদ দিবসে কলেজ ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা করা হলে পুলিশ ও কলেজ প্রশাসন তাতে বাধা প্রদান করে। তবে এ বাধা মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা ।
তৎকালীন ছাত্র সংসদ নেতা ইকবাল আনসারী খান, মাশির হোসেনসহ আরও অনেকেই পরিকল্পনা করেন শহীদ মিনার তৈরির। প্রথম এই শহীদ মিনার তৈরিতে ইডেন কলেজের ছাত্রীরাও সহায়তা করেছিল। একই দিন সন্ধ্যায় পল্টনের ব্রিটেনিয়া সিনেমা হল মিলনায়তনে ঢাকা কলেজের ছাত্র ও সংসদ নেতাদের উদ্যোগে ভাষা শহীদ দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং অনুষ্ঠানে ঢাকা কলেজের ছাত্র আতিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার উদ্দিন খান, জাহিদুর রহমানসহ কয়েকজন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি পরিবেশন করেন।
শিক্ষার্থীদের এমন কর্মকান্ডে কলেজ প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়ে ইকবাল আনসারী খান, আতিকুল ইসলামসহ ১০ জনকে দুই বছরের জন্য কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। ছাত্রদের সহায়তার অভিযোগে শিক্ষক সাইদুর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষকে বদলিও করা হয়। এভাবেই ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকা কলেজের অবদান স্মরণীয় আছে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available