ড. মো. আবদুল আউয়াল খান ও আজমাইন ইকতিদার মো. বিন হোসেন: বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসছে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা করার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি যেমন দেশের উন্নতির প্রতীক, তেমনই কিছু চ্যালেঞ্জও বয়ে এনেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এর গুরুত্ব সত্ত্বেও, এটি সম্ভাব্য পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, যেমন তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ, পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি ইত্যাদি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ধারণা ১৯৬০-এর দশক থেকে চলে আসছে। তবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের কারণে এটি দীর্ঘদিন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ গবেষণা ও পরিকল্পনার পর ২০১০ সালে সরকার পাবনা জেলায়, ঢাকা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট (রোসাটমের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান) ডিজাইন, নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। ওই ওয়েবসাইটের তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি পারমাণবিক চুল্লি থাকবে, প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ১,২০০ মেগাওয়াট (MW)। এটি সম্পন্ন হলে এটি হবে দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। প্রথম চুল্লির নির্মাণ কাজ ২০১৭ সালে শুরু হয় এবং এটি ২০২৩ সালে চালুর পরিকল্পনা করা হয়, দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এ বছরের শেষের দিকে চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে বিভিন্ন তথ্য মতে জানা যায় ।
রূপপুর প্রকল্পের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে টেকসই ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের উৎস প্রদান করা। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস, কয়লা ও তেলের মতো প্রচলিত জ্বালানির সীমাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ তুলনামূলকভাবে দীর্ঘমেয়াদে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে এবং এটি জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় পরিবেশের ওপর কম প্রভাব ফেলে। এটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বৈচিত্র্য আনবে এবং জ্বালানি সরবরাহে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু কার্বন নির্গমন কম হলেও, দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও চরম আবহাওয়ার ঘটনা, প্রতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
২০২৪ সালের মে মাসের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩২টি দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে, যা বৈশ্বিক বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রায় ১০% উৎপাদন করছে। পারমাণবিক শক্তি কম-কার্বন শক্তির উৎস। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির মতো ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে না। ফলে, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের পরিবেশগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ও পরিচালনা ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার শ্রমিক প্রকল্পে নিযুক্ত হয়েছে এবং এটি চালু হলে আরও দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হবে। এছাড়াও, প্রকল্পের কারণে স্থানীয় অবকাঠামো যেমন রাস্তা, বাসস্থান ও অন্যান্য পরিষেবার উন্নয়ন ঘটবে। ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিনির্ভর রূপপুর অঞ্চলে শিল্পোন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং স্থানীয় ব্যবসাগুলোর বিকাশ ঘটবে। শিল্প, বিশেষত টেক্সটাইল, সিমেন্ট ও উৎপাদন শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
পারমাণবিক শক্তি কম-কার্বন শক্তি উৎস, এটি পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। পারমাণবিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম হলেও, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা ব্যাপক তেজষ্ক্রিয় দূষণ ঘটাতে পারে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠী, কৃষি, জলাধার ও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও, পারমাণবিক বর্জ্য শত শত বা হাজার বছরের জন্য নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে এটি পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কঠোর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধির মধ্যে পরিচালিত হয়, তবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা এবং তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের সম্ভাব্য প্রভাব সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়া, নির্মাণকাজ চলাকালীন ধূলাবালি, শব্দদূষণ ও কম্পনের কারণে স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্যপ্রভাব পড়তে পারে। রূপপুর প্রকল্পের জন্য কয়েকশ পরিবারকে ইতোমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যদিও তাদের জন্য পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য সামাজিক ও মানসিক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে। বিশেষত কৃষিপ্রধান অঞ্চলে, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থানীয়দের জীবিকা নির্বাহে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিরাপত্তা ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন হ্রাসে অবদান রাখতে পারে। তবে, এই প্রকল্পের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকিগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে নিয়মিত আলোচনা, স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মানদণ্ড অনুসরণ করাই ঝুঁকি কমানোর প্রধান উপায়। বাংলাদেশের পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের এই যাত্রায়, অগ্রগতির পাশাপাশি দায়িত্বশীলতার ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক:
ড. মো. আবদুল আউয়াল খান, প্রফেসর, আইন বিভাগ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং
আজমাইন ইকতিদার মো. বিন হোসেন, এলএল. বি (ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন), এলএল.এম , ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available