মো. আতিকুর রহমান: মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের উত্থান একদিকে যেমন প্রশংসা ও জনপ্রিয়তার স্রোত বয়ে আনে, অন্যদিকে ঠিক তেমনভাবেই সমালোচনার ঝড় তোলে। রাজনীতি থেকে বিনোদন, সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যেসব ব্যক্তি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন, তাদেরকেই তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। বাস্তবতা হলো, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেই সমালোচনা আসবে, এটাই সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন আলোচিত ব্যক্তিরাই সমালোচিত হন? কেনই বা সাধারণ মানুষের তুলনায় জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ত্রুটি ও বিচ্যুতি নিয়ে এত বেশি আলোচনা হয়? এই প্রবন্ধে আমরা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো, যেখানে থাকবে খ্যাতি ও সমালোচনার পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকা এবং ইতিহাস ও বর্তমানের আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিদের উদাহরণ।
আলোচিত হলেই কেন সমালোচিত হতে হয়?
একজন ব্যক্তি যখন সাধারণের চেয়ে আলাদা হয়ে ওঠেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি সবার আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসেন। তার প্রতিটি কাজ, বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষ আলোচনা করতে শুরু করে। এই আলোচনার মধ্যে যেমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া থাকে, তেমনই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও উঠে আসে।
১. উচ্চ অবস্থানে থাকলেই প্রত্যাশার চাপ বেশি: সমাজের সাধারণ মানুষ জনপ্রিয় ব্যক্তিদের থেকে অতিরিক্ত প্রত্যাশা করে। তারা মনে করে, জনপ্রিয় মানুষদের জীবন হবে একদম নিখুঁত। ফলে তাদের সামান্য ভুলও বড় হয়ে ধরা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তবে সেটি সাধারণ রাজনীতিবিদদের ভুলের তুলনায় বেশি সমালোচিত হয়। একজন খ্যাতিমান শিল্পী বা লেখকের ছোটখাটো মন্তব্যও বড় বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। সেলিব্রিটিরা যদি সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করেন, তাতেও সমালোচনা হয়, আবার ভিন্ন আচরণ করলেও সমালোচিত হন।
২. জনপ্রিয়তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা: কোনো ব্যক্তি যখন আলোচিত হন, তখন তার চারপাশে একটি প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়। কিছু মানুষ তাকে অনুসরণ করতে চায়, আবার কেউ কেউ তাকে নিচে নামাতে চায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বীরা সমালোচনার মাধ্যমে তার ভাবমর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টা করে। যেমন রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তোলে। সিনেমা বা সংগীত জগতে একজন তারকা জনপ্রিয় হলে, তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
৩. মিডিয়ার ভূমিকা: গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত ব্যক্তিদের জীবনযাপন সবসময় চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। মিডিয়া এমনভাবেই সংবাদ প্রচার করে, যাতে বিতর্ক তৈরি হয়। নেতিবাচক খবর বেশি আকর্ষণীয় বলে মিডিয়া সেটিকে বেশি প্রচার করে। গসিপ এবং স্ক্যান্ডাল নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো বেশি আগ্রহী। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং বিষয়বস্তু সাধারণত বিতর্কিত হয়। এভাবেই আলোচিত ব্যক্তিরা খুব সহজেই সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।
সমালোচনা কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত? যারা আলোচিত, তাদের জন্য সমালোচনা অনিবার্য। কিন্তু এটি কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত? মানসিকভাবে শক্ত থেকে সমালোচনাকে ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, সব সমালোচনা খারাপ নয়, কিছু সমালোচনা থেকে শেখা উচিত। ভুল বা মিথ্যা প্রচার হলে তার বিরুদ্ধে সত্য তথ্য প্রচার করা উচিত। প্রতিটি সমালোচনার জবাব দেওয়া জরুরি নয়, কিছু সময় চুপ থাকাও কার্যকর হতে পারে।
আলোচিত ব্যক্তিরাই সমালোচিত হয়, এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। খ্যাতি যত বেশি, সমালোচনাও তত বেশি। রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী, খেলোয়াড় যেই হোক না কেন, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলে তাকে সমালোচনা সহ্য করতেই হবে।
তবে মনে রাখতে হবে সমালোচনা সবসময় খারাপ নয়। এটি যদি গঠনমূলক হয়, তাহলে ব্যক্তির উন্নতির পথ দেখাতে পারে। যারা প্রকৃত কাজ করে, তারা সমালোচনাকে ভয় পায় না। বরং তারা নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থাকে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সত্যিকারের মূল্যায়ন হয়। যারা আলোচনায় আসে, ইতিহাসে তাদের নামই থেকে যায়— সমালোচনার সঙ্গে, কিন্তু অমরত্বের গৌরবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, মাস্টার্স ১ম সেমিস্টার, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহ্বায়ক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available