নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নানারকম রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ব্যবসাবাণিজ্যে চলছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এ ছাড়াও সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। চলমান অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসায়ীরা ঘরে বসে যাচ্ছেন। ফলে দেশের বেশ কিছু শিল্প গ্রুপের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে কোনো শিল্প গড়ে উঠছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার পতনের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অনিয়শ্চতা তৈরি হয়েছে। আর এই অনিশ্চয়তা দূর করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে হবে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা-বাণিজ্য ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সুদ কমানোর পাশাপাশি ঋণখেলাপি করার বিধিতে ছাড় দিতে হবে। গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে তৎকালীন সরকার। এতে রপ্তানি খাতসহ শিল্প খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর থেকে পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠী কারখানায় ভাঙচুর, বিক্ষোভ ও হামলা চালিয়েছে। এরফলে তখন থেকেই সারা দেশে বিপুল সংখ্যক কারখানা বন্ধ রয়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অনিয়শ্চতা তৈরি হয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, এখনো অস্থিতিশীল রয়েছে দেশের অবস্থা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের নামে অযথা হয়রানিমূলক মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ীর পরিবারসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। সম্পদ জব্দ করা হচ্ছে। ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে যেতে পারছেন না। বিমানবন্দরে হয়রানি করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। এ ধরনের হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে ঘরে বসে যাচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে শিল্প খাতের অস্থিতিশীলতা নিরসনের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এখন নতুন ব্যবসা চালু হয়েছে- মামলা বাণিজ্য। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কারও মতের অমিল হলে মামলা দেওয়া হয়। যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন তাদের নামে মামলা বন্ধ করতে হবে।
ব্যাংক খাতে অরাজকতা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন ব্যাংকিং সেক্টরে নানা রকমভাবে আমরা বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। রপ্তানি করলে টাকা পাই না। কারখানার বেতন দেওয়া যাচ্ছে না।
আগামী মার্চ থেকে তিন মাসের মধ্যে অনাদায়ী কিস্তি পরিশোধ না করলে ব্যাংক যে কোনো ধরনের ঋণকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করবে। যেখানে বর্তমানে ছয় মাস পর সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে গণ্য হয়। এছাড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ঋণের সুদ বেড়ে ১৬-১৭ শতাংশে উঠেছে। ফলে কমেছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানো হলেও বাংলাদেশে বাড়ছে শিল্পঋণের সুদ। উচ্চ দামেও মিলছে না চাহিদামতো জ্বালানি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ; আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে জুনে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। বাং
লাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। গত জুলাই ও আগস্টে ১০ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। আগামী এক-দেড় বছরে রাজনীতি কোন দিকে যায়, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কারা ক্ষমতায় যেতে পারে, তা-ও তাঁরা বিবেচনায় রাখছেন। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ব্যবসা করার জন্য অধিকাংশ ব্যবসায়ীর নিজস্ব তহবিল নেই। ফলে অনেক সময় একাধিক পার্টনার ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোম্পানি গঠন করা হয়। এদের মধ্যে কোনো একজন ব্যক্তি অথবা একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে সেই প্রতিষ্ঠানের সুবিধা তো বন্ধ করে দেওয়া হয়ই, বাকি সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক সুবিধাও বন্ধ করা হয়। এতে সব প্রতিষ্ঠান বিপদে পড়ে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমাতে ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়িয়ে কোনো কাজ হবে না বলে আমি মনে করি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মানে জিনিসপত্রের দাম কমানো।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ ঋণ নেয় বড় বড় কোম্পানি, ব্যবসায়ী গ্রুপ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যক্তিগত ঋণ বাংলাদেশে অনেক কম। এটা বিদেশে অনেক বেশি। সেই কারণে বিদেশে মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানো হয়। আমাদের দেশে যে পাউরুটি বানায়, সে যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, পাউরুটি বানাতে তার খরচ বেড়ে যাবে। আলটিমেটলি সব জিনিসেই তো খরচটা বাড়ছে। তো এ জন্যই উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বিনিয়োগও ইতোমধ্যে কমে গেছে। আগামীতে আরও কমে যাবে। নতুন করে কর্মসংস্থান হবে না। আরও খারাপের দিকে গিয়ে কোথায় দাঁড়াবে বলা যাচ্ছে না। তথ্য সূত্র: দেশ রূপান্তর।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available