নিজস্ব প্রতিবেদক: গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ: নির্বাচন, অর্থনীতি ও বহিঃসম্পর্ক’ শীর্ষক গোলটেবিল অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনটি একটি একপাক্ষিক নির্বাচন, যা দেশকে সংকটে ফেলবে।
তাদের মতে, এ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা পাবে না। এর ফলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও বাধার মুখে পড়তে হতে পারে। বিশেষ করে, গার্মেন্টস শিল্পের ওপর কোনোধরনের নিষেধাজ্ঞা আসলে, এতে কর্মরত লাখ লাখ নারী ও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাবে ফেলবে। এছাড়াও, একতরফা নির্বাচন দেশের উন্নয়নে অংশীদার দেশগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ককে আরও শীতল করে তুলবে। তাই গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উপহার দিতে, সকল বড় দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, এমন একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
২০ ডিসেম্বর বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুজনের সেক্রেটারি ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আইন ও সালিশ কেন্দের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হুসাইন (অব.), নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমান্ডার (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, সিজিএসের চেয়ারম্যান ডা. মনজুর আহমেদ চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ও নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বৈধতা থাকুক বা না থাকুক, আমরা একটি একপাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। এখানে সরকার দল কে হবে ও বিরোধী দল কে হবে তা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে এবং তথাকথিত বিরোধী দল ইতোমধ্যে সিট ভিক্ষার রাজনীতি শুরু করেছে। এবারের নির্বাচনে সিট ভিক্ষার রাজনীতি নিয়ে অনেকেই অবাক হলেও বিগত দু’টি নির্বাচনেও এমনই ছিল।
তিনি জানান, দেশের তরুণ সমাজ টানা তিনটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের বর্তমান অচল অবস্থা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে তিনি বলেন, রাজনীতি কখনও শূন্য থাকে না, কেউ না কেউ সেখানে চলে আসে। আমার ভয় হচ্ছে, এই অচল অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেই শূন্যস্থানে চরমপন্থীরা চলে আসতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, যা নিয়ে কখনও কেউ খুব একটা কথা বলে না।
তিনি জানান, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছিল, যা অসাংবিধানিক। এই পদ্ধতিতে হাইকোর্টের রায়কে সঠিকভাবে মানা হয়নি বলে জানান তিনি। এছাড়াও, জনগুরুত্বপূর্ণ আইন বা বিধান পরিবর্তনের আগে গণভোট করার অত্যাবশ্যকিয়তা রয়েছে সংবিধানে। অথচ, এক্ষেত্রে সেটিও অনুসরণ করা হয়নি।
সুজনের সেক্রেটারি আরও বলেন, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন, অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে প্রণীত নিয়মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন ও একচেটিয়া অংশগ্রহণের এই নির্বাচন দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্থ করবে।
ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মিলছে না। আমি মনে করি, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখিয়ে কিছু লোক অবৈধভাবে অর্থ লোপাট করেছে এবং তাদের নিজেদের পকেট সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু দেশের সমৃদ্ধি ঘটেনি।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সমস্যা হলো আমরা আমাদের সংকটগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাই, মানতে চাই না। বহুদিন থেকে আমরা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ছিলাম, আমরা সেটা অস্বীকার করে বলেছি, যে না আমরা ভাল আছি। অথচ, এখন আমরা মহাসংকটের দাঁড় প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।
তিনি বলেন, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে জবাবদিহিতার প্রচন্ড অভাব রয়েছে। অনেকেই গণতন্ত্র আর অর্থনীতিকে আলাদা করে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অথচ অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করা যাবে না। গণতন্ত্রের অনেক সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু সেখানে যদি অংশগ্রহণ না থাকে, জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে সেটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। গণতন্ত্রহীন সমাজে জবাবদিহিতা থাকে না, আর তার সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতির বিষয়ে সরকারের তৈরি করা বা প্রকাশ করা ন্যারেটিভ বা বক্তব্য দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সাথে মিলে না। জিডিপিকে যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণনা করা যায় না, তাই সেখানে বেশি সংখ্যা বসিয়ে দিয়ে দেশকে উন্নত হচ্ছে বলে দেখানো হচ্ছে। অথচ যেই অর্থগুলো গণনা করা যায়, যেমন বৈদশিক অর্থের রিজার্ভ, তা তো আর বাড়িয়ে বলা যায় না, তাই সেটি কম না দেখিয়ে উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, সরকার যেকোনোভাবে একটা ইলেকশন করে ফেললেও তা দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য না হলে তার প্রভাব অর্থনীতির উপর এসে পড়বে। ফলে নির্বাচন পরবর্তী দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ও গতিশীল রাখাই হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে সবার মত নির্বাচন বলতে আমার দ্বিধা আছে, এটিকে বিশেষ নির্বাচনি তৎপরতা বলা যায়।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বৈধতার সংকট থাকলে সেই রাষ্ট্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তার মতে, সাম্প্রতিক দু’টি নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক বৈধতা রক্ষা করতে পারলেও, রাজনৈতিক বৈধতা রক্ষা করা যায়নি। দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন পাওয়া একটি দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা মানে হচ্ছে, এতগুলো মানুষকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা, যা এ নির্বাচনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয় না।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available